সার-তেলের বাড়তি দাম সংকটে ফেলেছে কৃষকদের
নীলফামারী জেলা শহরের ময়দান পাড়া এলাকার কৃষক ফয়জুল ইসলাম চার বিঘা জমিতে আমন আবাদ করছেন। ৩০ বছর বয়সী এ কৃষক আক্ষেপ করে বলেন, ‘হামরা তো শ্যাষ হয়া যাইছি (আমরা তো শেষ হয়ে যাচ্ছি)। আকাশের (বৃষ্টির) পানিত আমন হয়, এইবার আকাশেরও পানি নাই। মোটর দিয়ে সেচ দেওয়া লাগতোছে। খরচ বাড়িল। কয়েক দিন আগোত সারের দাম বাড়িল। ৮০০ টাকা থাকি ১১০০ টাকা হইল। ফির কাইল থাকি তেলের দাম বাড়িল। কেমন করি পোষাইবে।’ এমনই প্রশ্ন জেলার অন্য কৃষকদের। এ সংকট থেকে উত্তরণেরও পথ কী?
একই এলাকার আজিজুর ইসলাম। দুই বিঘা জমিতে আমন আবাদ করেছেন। সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়ার পর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় হতাশ তিনি।
আজিজুর বলেন, ‘সব জিনিসের দাম বেড়েছে। আমাদের তো শুধু ক্ষতিই হচ্ছে। কৃষকদের তো অনাহারে কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে।’
এমন কোনো জিনিস নাই যে দাম বাড়ে নেই- এমন মন্তব্য করে আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এবার আমন মৌসুমে যে খরচ হয়েছে, এর আগে কখনো তা হয়নি। সার, তেলের দাম বাড়লে অটোমেটিক কৃষির সব উপকরণের দাম বাড়বে, এইটাই স্বাভাবিক।’
কৃষক ফয়জুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষির কি যে অবস্থা! হামরা কৃষকরা কোন পাকে যাই? (আমরা কৃষকরা কোন দিকে যাব?) সউগসময় টেনশন করিবার নাগে (সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়)।’
একই এলাকায় আমন ক্ষেতে আগাছা পরিষ্কার করছেন কাঞ্চন বালা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, গরিবের বিপদ সবঠে (সবখানে)। অল্প এনা আবাদ করি (অল্প কিছু ফসল আবাদ করি)। স্বামী-স্ত্রী দুইজন মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করি সংসার চালেবার নাগে (চালাতে হয়)। হামার মজুরি তো আর বাড়ে নাই। যেমন করি সার তেলের দাম বাড়িল ওই রকম যদি ফসলের দাম বাড়িল হয় তাহলে কৃষকও ভালো থাকিল হয়।’
কৃষি কাজের অন্যতম প্রয়োজনীয় এ দুই উপকরণের দাম বাড়ায় আক্ষেপ শুধু ফয়জুল, আজিজুল বা কাঞ্চন বালারই নয়। মনে আক্ষেপ রয়েছে নূর বানু, হাফিজুল ইসলাম এবং অনিল রায়ের মতো সব কৃষকের মধ্যেও।জেলা শহরের ময়দানপাড়া, দেবির ডাঙ্গা, মিলনপল্লী ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এমন প্রতিক্রিয়াই দেখা গেছে।
দেবিরডাঙ্গা এলাকায় জমি চাষ করতে আসা কচুকাটা এলাকার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জমির মালিকের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। আগে বিঘা প্রতি ৩৫০ টাকা দেয়ার কথা ছিল। তবে তেলের দাম বাড়ায় এখন প্রতিবিঘা ৪০০ টাকার কম নেয়া যাবে না। দাম না মেলায় দুই জনের জমি চাষ করিনি। আরেকজনের জমি চাষ করে হাল বন্ধ করে দিলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। তারপর গাড়ি নিয়ে বের হব।’
কৃষকরা বলছেন, ফসল উৎপাদন করে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় ও খরচ বেশি হওয়ায় কৃষকরা বেকায়দায় পড়ছেন। গেল বোরো মৌসুমে বৃষ্টি আবাদ শেষ করে দিয়েছে। যার কারণে কৃষকরা লোকসানে পড়েন। এবার আমন আবাদের শুরুতে নানান ধাক্কার মুখে পড়তে হচ্ছে। আবাদ ঘরে না তোলা পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে বুঝা যাচ্ছে না।
এদিকে তেলের দাম বাড়ার পর থেকে নতুন দামে বিক্রি করছেন পেট্রোল পাম্প মালিকরা। এ বিষয়ে জেলা শহরের বনবিভাগ এলাকার পেট্রোল পাম্প রশিদা ফিলিং স্টেশনের বিক্রয় কর্মী মতিবুল ইসলাম জানান, আমরা নতুন দরে তেল বিক্রি করছি। তবে ক্রেতা তুলনামূলক কম।
জেলা পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আখতার হোসেন স্বপন বলেন, তেলের কোনো সংকট নেই। আমরা নতুন দামে তেল বিক্রি করছি। জেলায় ৩৭টি পেট্রোল পাম্প রয়েছে।
সার, তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষিতে দারুণ প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের জেলা কমিটির সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ সরকার।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সারের দাম বাড়ল। কিন্তু আমরা আমাদের মজুত করা সার নতুন দামে বিক্রি করিনি। কিন্তু তেলের ক্ষেত্রে চিত্রটি পুরোই উল্টো। মজুত করা তেল পূর্বের দামেই বিক্রি করা উচিত। জ্বালানির দাম বাড়ায় পরিবহন ব্যয় বাড়বে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব সবখানে পড়বে।’
সার ডিলারদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে, তাদের ২০ বছর আগের কাঠামোতে কমিশন দেয়া হয় জানিয়ে তিনি সরকারকে কমিশন দ্রুত বাড়ানোর অনুরোধ করেন।
বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির জেলা কমিটির সভাপতি তপন কুমার বলেন, ‘যদিও এটি বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বাড়াতে হয়েছে। তারপরও এক দফায় এতটা বাড়ানো ঠিক হয়নি। সারের দাড় বাড়ানোয় আমরা প্রতিবাদ করলাম। এখন তেলের দাম বাড়ানো হলো। নিশ্চয় শুধু কৃষি নয়, মানুষের প্রতিটি কাজে এর প্রভাব ফেলবে। আমরা সরকারের কাছে বলতে চাই- যেন বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা হয়।