img

চীনে সবার আগে কোভিড-১৯ ধরা পড়ল, আবার তারাই সবার আগে রোগ নিয়ন্ত্রণ করল। মার্চ থেকে তারা মোটামুটি অর্থনৈতিক কার্যক্রমও শুরু করেছে। এখন তারা সক্ষমতার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে লক ডাউনের পর জীবন কেমন হতে পারে, সেই নজিরও স্থাপন করেছে চীন। তবে ৯০ শতাংশ কার্যক্রম চালানোও অবিশ্বাস্য বলে মনে করছে দ্য ইকোনমিস্ট। এক ভিডিও সংবাদে সে কথাই বলেছে তারা।

চীনে কারখানা খুলে গেছে, স্কুল-কলেজে ক্লাস হচ্ছে, রেস্তোরাঁ ও গণপরিসর উন্মুক্ত করা করা হয়েছে। এরপরও অর্থনীতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসেনি। স্বাভাবিক পর্যায়ের ৯০ শতাংশ সক্ষমতায় কাজ করছে চীনা অর্থনীতি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অর্থনীতি চালাতে গেলে চীনের মতো ১০ শতাংশ সংকোচন খুব স্বাভাবিক, তা সে দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সওইডেন, যেখানেই হোক না কেন।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই যে ১০ শতাংশ সংকোচনের কথা বলা হচ্ছে, এতে জীবনযাত্রা স্বাভাবিকতা থেকে বেশ দূরেই থাকবে। চীনেও দেখা যাচ্ছে, স্বাভাবিক সময়ের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অনেকাংশই অনুপস্থিত। জানুয়ারিতে লক ডাউনের পর এপ্রিলে ভোক্তা ব্যয় জানুয়ারির তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে, হোটেলে কক্ষ ভাড়া নেওয়ার হারও ৫০ শতাংশ কম; যদিও মার্চেই সব খুলে গেছে।

দ্য ইকোনমিস্টে অর্থনীতি বিষয়ক জ্যেষ্ঠ লেখক ক্যালাম উইলিয়াম বলেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে রেস্তারাঁ, সিনেমা, শপিং মল এসব জায়গায় মানুষ আগের মতো ভিড় করছে না। অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় মানুষ আগে যেখানে মজা করার জন্য আড্ডা মারত বা কোথাও যেত, সেটাও এখন নেই। মানুষ কাজ সেরে পড়িমরি করে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। এই প্রবণতা আরও বেশ কিছুদিন চলবে বলে মনে করছে তারা।

অন্যদিকে সুইডেনে অধিকাংশ মানুষকে কখনোই ঘরে থাকতে বলা হয়নি। কিন্ত পাশের দেশ ডেনমার্কে মানুষ লকডাউনের সময় যেভাবে ব্যয় করেছে, সুইডিশদের মধ্যেও সেই প্রবণতা দেখা গেছে। এপ্রিলে সুইডেনে রেস্তোরাঁর ব্যবসা ৭০ শতাংশ কমে গেছে। অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা যেমন ছিল, তেমনি রোগ সংক্রমণের ভয়ও ছিল, এতেই এই ধস। মানুষ খরচ করতে ভয় পাচ্ছে। অন্যদিকে লক ডাউনের সময় ডেনমার্কে মানুষের ব্যয় ২৯ শতাংশ কমে গেছে। সুইডিশদের ব্যয় কমার হারও সেরকম।

ব্যাপারটা হচ্ছে, এটা মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত—এই সময় তারা ব্যয় করবে কি করবে না। বাংলাদেশের প্রসঙ্গে বলা যায়, যারা হয়তো এই ঈদে স্মার্ট টিভি কিনতেন, তারা ভেবেছেন, এখন ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেই। তবে স্বাভাবিক সময়ে তাঁরা হয়তো এটা ভাবতেন না। অথবা যার দাঁতের ফিলিং করানো দরকার, এই সময় তাঁরা সেটা করাচ্ছেন না। টাকার প্রসঙ্গ তো আছেই, সঙ্গে রোগ সংক্রমণের ভয়ও আছে। মানুষের এই সিদ্ধান্ত অর্থনীতির গতিপথ নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এটা অর্থনৈতিক পূর্বাভাস বা সরকারি ভাষ্যের ওপর নির্ভরশীল নয়।

এ জন্য ইকোনমিস্ট মনে করছে, লকডাউনের প্রকৃত প্রভাব টের পেতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে। চীনেও লক ডাউন তোলার মাসখানেক পরে দেউলিয়া হওয়ার আবেদন বাড়তে শুরু করে। লকডাউন তোলার পরই সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারগুলো ঘটতে শুরু করবে।

লকডাউনের সময় সরকারি সহায়তায় অর্থনীতি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সরকারি সহায়তার পরিমাণ অভূতপূর্ব। ইউরোপের বৃহতম পাঁচটি অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি পাঁচজন কর্মীর মধ্যে একজন কর্মী বিশেষ স্কিমের আওতায় আছেন। রাষ্ট্র তাঁদের মজুরি দিচ্ছে।

বাংলাদেশেও সরকার বিভিন্নভাবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করছে। রাজস্ব ঘাটতির কথা এখন তেমন কেউ ভাবছেন না। মার্চ মাসে যুক্তরাজ্য সরকার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যত পরিমাণ সহায়তা দিয়েছে, লিপিবদ্ধ ইতিহাসে এক মাসে কখনোই এত পরিমাণ দেওয়া হয়নি। কিন্তু এক সময় তো এসব সহায়তা তুলে নিতে হবে, তখন অর্থনীতির প্রকৃত চেহারা বোঝা যাবে।

ইকোনমিস্ট উদাহরণ দিচ্ছে, লক ডাউনের সময় এক ছোট রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী যদি ঋণ নিয়ে কর্মীদের ছুটিতে পাঠিয়ে থাকেন, লকডাউন উঠে গেলে তিনি দেখবেন, মানুষ আর সেভাবে খেতে আসছে না। তখন তিনি স্বাভাবিকভাবেই কর্মীদের ছাঁটাই করবেন এবং রেস্তোরাঁও বন্ধ করে দেবেন। ইতিমধ্যে তা শুরু হয়েও গেছে। বছরের প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাজ্যে বাণিজ্যিক প্লটের ভাড়াটিয়াদের সময় মতো ভাড়া পরিশোধের হার ৯০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশে নেমে এসছে। বার্গার কিংয়ের মতো বড় প্রতিষ্ঠানও বলছে, শূন্য রেস্তোরাঁর ভাড়া তারা দিতে পারবে না। ভাড়া না পেলে বাড়িওয়ালাও ব্যাংকের ঋণ পরিশাধ করতে পারবে না। এই সমস্যা সব দেশেই দেখা যাবে।

সবকিছু এত অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে বিনিয়োগ করা শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিনিয়োগ হ্রাসের প্রভাব বেশ গুরুতরই হবে।

গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বিশ্ব এক প্রলম্বিত মন্দার কবলে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ইতিমধ্যে মহামন্দার পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তবে সব খাত এটা সমানভাবে অনুভব করবে না। শ্রমঘন ও নিম্ন মজুরির শ্রমিকেরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। উল্লিখিত রেস্তেরাঁর উদাহরণ দিয়েই তা বোঝানো যায়। যুক্তরাষ্ট্রে যাঁদের আয় বছরে ২০ হাজার ডলারের কম, তাঁদের কাজ হারানোর ঝুঁকি ৮০ হাজার ডলারের বেশি আয়েরর মানুষের চেয়ে বেশি।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এসবের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বিশ্ববাসী মুক্ত থাকতে পারবে না। কোন দেশ কীভাবে তা মোকাবিলা করবে, এর ওপরই সবকিছু নির্ভর করবে।

জিরোআওয়ার২৪/এমএ   

এই বিভাগের আরও খবর