img

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় নির্বাচনী এলাকা থেকে দূরে আছেন বেশির ভাগ সাংসদ। তবে প্রায় সব সাংসদের পক্ষ থেকে নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে কমবেশি ত্রাণ বিতরণের খবর পাওয়া গেছে। আর ২৯৬ জন সাংসদের মধ্যে এলাকায় থেকে সরাসরি ত্রাণ বিতরণে কাজ করেছেন ১৩৯ জন, যাঁর মধ্যে ১৪ জন মন্ত্রী।

৮ থেকে ১২ মে পর্যন্ত সারা দেশে মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে। অন্য সময় নিয়মিত আসা-যাওয়া থাকলেও সরকারি ছুটি ঘোষণার পর একবারও এলাকায় যাননি ৭৫ সাংসদ। এলাকায় দেখা যায়নি ১৫ জন মন্ত্রীকেও। আর অন্তত একবার হলেও এলাকায় গেছেন ৮২ জন সাংসদ।

করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত ২৬ মার্চ থেকে ছুটি চলছে দেশে। এপ্রিলের শুরুর দিকেও হাতে গোনা কয়েকজন সাংসদ এলাকায় যান। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে এলাকায় যেতে শুরু করেন অনেকে। ওই সময় সরকারি দলের সাংসদদের এলাকায় যেতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন বলে জানান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দুজন নেতা। ওই সময় ১৩ জন সাংসদ একবারের জন্য এলাকায় গিয়ে আবার ঢাকায় ফিরেছেন।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, যেকোনো দুর্যোগে ভরসার কেন্দ্রে থাকেন সাংসদ। সবাই তাঁর কাছে ছুটে যান। দরপত্র থেকে শুরু করে এলাকার সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন সাংসদ। কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির চাল, গমও তাঁর নির্দেশনায় ভাগাভাগি হয়।

সব দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণেও নেতৃত্ব দেন সাংসদ। এবার ভিন্ন চিত্র। করোনার ভয়ে এলাকায় থাকছেন না অনেক সাংসদ। এবার ত্রাণের নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের হাতে থাকায় এলাকায় থাকতে সাংসদের তেমন আগ্রহ নেই বলেও মনে করছেন অনেকে।

২৯৬ সাংসদের মধ্যে এলাকায় থেকে সরাসরি ত্রাণ বিতরণে কাজ করেছেন ১৩৯ জন। যাঁর মধ্যে ১৪ জন মন্ত্রী।

করোনাকালে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি ত্রাণ বিতরণে গঠিত ‘মানবিক সহায়তা কমিটি’র প্রধান উপদেষ্টা হলেন স্থানীয় সাংসদ। তাঁর পরামর্শ ও নির্দেশনায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। তবে অধিকাংশ সাংসদ সেই পরামর্শ দিচ্ছেন ফোনে। ত্রাণের অপ্রতুলতা নিয়ে অভিযোগ আছে কোথাও কোথাও। ত্রাণের দাবিতে অন্তত ৪৫ স্থানে বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। রংপুর সদরে জাতীয় পার্টির সাংসদ রাগীর আল মাহীর (সাদ এরশাদ) বাড়ি ঘেরাও করেছিলেন স্থানীয় লোকজন। এরপর তিনি এলাকায় যান।

করোনাকালে এলাকায় না যাওয়া ৭৫ সাংসদের মধ্যে আছেন সরকারি দল আওয়ামী লীগের ৫৬ জন, জাতীয় পার্টির ৯, সরকারি দলের মিত্র দলগুলোর ৪, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৪ এবং ২ জন স্বতন্ত্র সাংসদ। ৩০০ আসনের মধ্যে চারটি আসনে সাংসদ মারা যাওয়ার পর এখনো নির্বাচন হয়নি। এর মধ্যে তিনটিতে তফসিল ঘোষণা হলেও করোনার জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বাদে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী মিলে ৪৭ জনের মন্ত্রিসভায় চারজন টেকনোক্র্যাট সদস্য। বাকি ৪৩ জনের মধ্যে ১৪ জনকে এলাকায় পাওয়া গেছে, আর ১৪ জন আসা-যাওয়া করছেন। বাকি ১৫ জন একবারের জন্যও এলাকায় যাননি।

বিভিন্ন কারণে এলাকায় যেতে পারেননি এমন মন্ত্রীদের মধ্যে আছেন শিল্পমন্ত্রী নরসিংদীর সাংসদ নূরুল মজিদ হুমায়ুন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মানিকগঞ্জের জাহিদ মালেক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ফেনীর ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী চাঁদপুরের দীপু মনি, বাণিজ্যমন্ত্রী রংপুরের টিপু মুনশি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অবশ্য বাসা থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাসা থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনা প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

তবে ২৮ জন মন্ত্রী সরাসরি এলাকায় উপস্থিত হয়ে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ঢাকায় অবস্থান করতে হয়। কিন্তু প্রতি মাসে এলাকায় যাই।’

পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক বলেন, ঢাকায় মন্ত্রণালয়ের কাজ না থাকলে এমন দুর্যোগের সময় জনগণের পাশে সার্বক্ষণিক থাকতেন। তিনি ১৬ বার এলাকায় গিয়েছেন বলে জানান।

সরকারি দলের সাংসদেরা অধিকাংশই এলাকায় না যাওয়ার কারণ হিসেবে নিজের বয়স ও অসুস্থতাকে সামনে এনেছেন। আবার অনেকে বলেছেন, লকডাউন চলার কারণে যেতে পারছেন না। তাঁরা নিয়ম মেনে ঘরেই আছেন। আবার অনেকে সরকারি দায়িত্ব পালনে ব্যস্ততার কারণে ঢাকায় থাকছেন। মন্ত্রীদের অনেকে আবার বারবার গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।

মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়া আওয়ামী লীগের যেসব সাংসদ এলাকায় যাননি, তাঁদের মধ্যে আছেন গোপালগঞ্জের শেখ ফজলুল করিম সেলিম, রাজবাড়ীর জিল্লুল হাকিম, মাদারীপুরের আবদুস সোবহান গোলাপ, টাঙ্গাইলের আতাউর রহমান খান, কিশোরগঞ্জের নাজমুল হাসান, নোয়াখালীর মোরশেদ আলম, লক্ষ্মীপুরের শহীদুল ইসলাম এবং কে এম শাহজাহান কামাল, চাঁদপুরের মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শফিকুর রহমান ও রফিকুল ইসলাম, সিলেটের হাফিজ আহমেদ মজুমদার ও নুরুল ইসলাম নাহিদ, যশোরের শেখ আফিলউদ্দিন, সাতক্ষীরার আ ফ ম রুহুল হকসহ আরও অনেকে।

এই তালিকায় আছেন আবদুল মতিন খসরুও। তিনি বলেন, শারীরিক কারণে নির্বাচনী এলাকায় যাওয়া হয়নি।

অনেকে বলছেন, পরিস্থিতির উন্নতি হলেই এলাকায় যাবেন। কেউ বলছেন, এলাকায় গিয়েই মানুষকে ত্রাণসহায়তা দিতে হবে কেন? এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। আর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বললেন, রাষ্ট্রীয় কাজে তাঁকে ঢাকায় থাকতে হচ্ছে।

চাঁদপুরের পাঁচজন সাংসদই আছেন এলাকার বাইরে। চারজন একবারও এলাকায় যাননি। সাংসদদের দেওয়া ত্রাণের অপ্রতুলতা নিয়েও অভিযোগ আছে এলাকায়, বিশেষ করে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের এলাকায়। তবে সাংসদ রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম বলেন, এলাকায় না গেলেও ৯ হাজার পরিবারকে ব্যক্তি উদ্যোগে খাদ্যসহায়তা দিয়েছেন তিনি।

বয়সের ঝুঁকি বিবেচনা করে সরকারদলীয় কয়েকজন সাংসদকে এলাকায় না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় সংসদের দুজন হুইপ জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কয়েকজন সাংসদকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তবে সেই সংখ্যা খুব বেশি নয়। ফরিদপুরের সাজেদা চৌধুরী, ভোলার তোফায়েল আহমেদ, ঝালকাঠির আমির হোসেন আমু, শেরপুরের মতিয়া চৌধুরী, গাইবান্ধার ফজলে রাব্বি মিয়া, নীলফামারীর আসাদুজ্জামান নূর আছেন এ তালিকায়। অবশ্য মতিয়া চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ি না থাকায় ও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এলাকায় যেতে পারেননি তিনি।

সরকারি দলের ১২৪ জন সাংসদ এলাকায় থেকে কাজ করছেন। এর মধ্যে অনেকেই টানা এলাকায় থাকছেন। এদিকে এলাকায় থেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন নওগাঁর সাংসদ শহীদুজ্জামান সরকার। এরপর ১ মে থেকে তিনি ঢাকাতেই আছেন। আবার ব্যবসায়িক কারণে ঢাকায় থাকলেও মাঝেমধ্যে এলাকায় যাচ্ছেন অনেক সাংসদ। নরসিংদীর জহিরুল হক ভূঁইয়া জানান, স্থায়ীভাবে বসবাস ও ব্যবসার কারণে রাজধানীতে থাকতে হচ্ছে। তবু চারবার এলাকায় গিয়ে ত্রাণকাজে অংশ নিয়েছেন।

গাইবান্ধা-২ আসনের সাংসদ ও জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম বলেন, ‘এত বড় একটা দুর্যোগ, আমি কীভাবে ঢাকায় থাকি। সব সময় জনগণের সুখে-দুঃখে ছিলাম। এখানো তাদের পাশে রয়েছি।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মোট সাংসদ আটজন। এর মধ্যে বিএনপি থেকে নির্বাচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের হারুনুর রশীদ ও আমিনুল ইসলাম, বগুড়ার গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ এলাকায় যাননি। হারুনুর রশীদের ভাষ্য, এলাকায় থাকলেই লোকসমাগম হয়। ত্রাণের যে চাহিদা, তা মেটানো সম্ভব হয় না। তা ছাড়া সরকারি ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় সাংসদদের কোনো ভূমিকা নেই। আমিনুল ইসলাম বললেন, লোকসমাগম এড়াতেই বাইরে আছেন।

বগুড়ার সাংসদ মোশাররফ হোসেন একবার গিয়ে ত্রাণ দিয়ে এসেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া সম্প্রতি এলাকায় গেছেন। গণফোরাম থেকে নির্বাচিত মৌলভীবাজারের সাংসদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর একবারও এলাকায় যাননি । তিনি বলেন, করোনার কারণে নির্বাচনী এলাকায় যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

একাদশ সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদ ২২ জন। এর মধ্যে এলাকায় আছেন ৮ জন। আর ৫ জন মাঝেমধ্যে গিয়ে ত্রাণ দিয়ে এসেছেন। বাকি ৯ জন একবারের জন্যও এলাকায় যাননি। এঁদের মধ্যে আছেন ফেনীর মাসুদউদ্দিন চৌধুরী, ময়মনসিংহের রওশন এরশাদ ও ফখরুল ইমাম, লালমনিরহাটের জি এম কাদের প্রমুখ। এ তালিকায় আছেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করে পার্টির উদ্যোগে কর্মহীনদের মধ্যে ত্রাণসহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছি।’

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক ও মিত্র দলগুলো থেকে সাংসদ হয়েছেন ৯ জন। এঁদের ৪ জনকে এলাকায় দেখা যায়নি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিকল্পধারার লক্ষ্মীপুরের আবদুল মান্নান ও মুন্সিগঞ্জের মাহি বি চৌধুরী এলাকায় যাননি। এলাকায় যাননি জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। ইনু বলেন, শারীরিকভাবে না থাকতে পারলেও প্রতিদিন দুবার করে দুই উপজেলার ইউএনও, চিকিৎসা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনীতি এখন জনকল্যাণে নয়, ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত হয়। সাধারণত যেখানে স্বার্থ থাকে না এবং ঝুঁকি থাকে, অধিকাংশ সাংসদই সেখান থেকে দূরে থাকেন। তাই করোনা পরিস্থিতিতেও সামাজিক দূরত্বে আছেন সাংসদেরা। পাঁচ বছর পরপর ভোট চাইতে হলে জনগণের প্রয়োজনে ঠিকই পাশে থাকতেন তারা।

জিরোআওয়ার২৪/এমএ   

এই বিভাগের আরও খবর