img

আশার বয়স ১২ বছর। রাজধানীর একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে সে। মা–বাবার সঙ্গে রাজধানীর শান্তিনগরে থাকে। বাবা পেশায় চিকিৎসক। মা গৃহিণী। তার বাবার শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। তাই তিনি ভর্তি আছেন হাসপাতালে। আশার সময় কাটছে এখন মায়ের সঙ্গে।

আশার বাবা বললেন, 'এক মাস আগে আমার মেয়ের স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুলে যেতে পারে না, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। সারা দিন ঘরে। আবার পেশাগত কাজ করতে গিয়ে আমার দেহে করোনাভাইরাস। বাধ্য হয়ে আমি ঘরের বাইরে। এখন মেয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। মেয়ের কিছুই ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে সে।'

১৪ বছরের রেদোয়ান। পড়াশোনা করছে রাজধানীর একটি স্কুলের দশম শ্রেণিতে। মা–বাবার সঙ্গে থাকে পুরান ঢাকার মুরগিটোলার একটি ফ্ল্যাটে। দেশের অন্যসব শিক্ষার্থীর মতো এখন ঘরবন্দী।

রেদোয়ান বলল, 'স্কুল বন্ধের প্রথম এক সপ্তাহ ঘরে থাকতে ভালো লেগেছিল। এখন মোটেও ভালো লাগে না। মন খুব খারাপ হয়। কিন্তু কী করব? বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ে। স্কুলে গিয়ে একসঙ্গে গল্প করতাম, খেলাধুলা করতাম। এগুলো খুব মিস করছি। জানি না আর কত দিন এভাবে ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হবে?'

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকারি সিদ্ধান্তে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের স্কুল–কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। দেশের সব শিক্ষার্থী এখন ঘরে অবস্থান করছে। স্কুল-কলেজ খোলা থাকার সময় একজন শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন রুটিনে বৈচিত্র ছিল। কিন্তু এখন তাদের একঘেয়ে সময় কাটাতে হচ্ছে। করোনার এই মহামারির সময়ে সবচেয়ে বেকায়দায় রয়েছে কিশোর-কিশোরী। আবার করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়া ও সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন মনোচিকিৎসকদের মতে, করোনার এই সময়ে কেউ ভালো নেই। সবাই একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। নিকট অতীতে করোনাভাইরাসের মতো এমন মহামারি দেখার অভিজ্ঞতা কারও নেই। এতে স্বাভাবিকভাবে সববয়সী মানুষের ভেতর একটা আতঙ্ক রয়েছে। কিশোর–কিশোরীর আতঙ্ক আবার বেশি। প্রতিদিন এই বয়সে তারা নতুন নতুন জিনিস শেখে। নিজেদের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। সামাজিক দক্ষতা তৈরি হয়। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকায় তাদের দৈনন্দিন রুটিনে মারাত্মক ছন্দপতন হয়েছে। এই বয়সীরা সাধারণত সমবয়সীদের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে, তাদের মনের কথা শেয়ার করে। কিন্তু সেগুলো তারা পারছে না। ফলে তাদের ভেতর মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এতে মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম বলেন, 'লকডাউন কিংবা কোয়ারেন্টাইন সিচুয়েশনে কিশোর কিংবা কিশোরী কিন্তু বাইরে বের হতে পারছে না। এমনিতে এই বয়সে মা–বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব থাকে। তারা ঘর থেকে বাইরেও বের হতে পারছে না। তারা একটা সমস্যার মধ্যে আছে। তারা হয়ত বুঝতে পারছে না, তারা কী করবে? কেউ কেউ টেকনোলোজির সঙ্গে বুদ হয়ে যাচ্ছে। আঠার মতো লেগে থাকছে। বাবা-মা হয়তো তাদের মানা করছেন। বাবা-মা তাদের যা করতে বলছে, তা তারা করতে চাইছে না। তারা এখন একই ছাদের নিচে। দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থাকার কারণে তাদের ওপর অনেক বেশি নজরদারি বেড়েছে। স্বাধীনভাবে তারা কিছু করতে পারছে না। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে পারছে না, বাইরে যেতে পারছে না। বাইরে খেতে যেতে পারছে না। তারা আড্ডা দিতে পারছে না। আড্ডা থেকে যে প্রাণশক্তি আমরা পাই, সেই প্রাণ শক্তি থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে অভিভাবকদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে তাদের ভেতর মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এতে অনেক ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। করোনা ভাইরাসের মহামারি চলে গেলেও এই ধরনের মানসিক অসুস্থতা কিন্তু ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।'

করোনা ভাইরাসের মহামারি চলে যাওয়ার পরও কিশোর বয়সী ছেলেমেয়ে আগের মনোজগতে ফিরতে পারবে না বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, 'যেকোনো বৈশ্বিক মহামারি বা মহাদুর্যোগ যখন ঘটে, তখন তা মানুষকে কেবল শারিরীকভাবে আক্রান্ত করে না, তার মনন, তার চিন্তা, তার সামাজিকতা, তার অর্থনীতি, তার রাজনীতি সব বিষয়কে কিন্তু নতুন মোড়ের দিকে নিয়ে যায়। সেই ধারা থেকে কিন্তু আমাদের কিশোর বয়সীরা বাইরে না। কিশোরদের যে বয়স, সেটা বিকশমান। তারা বিকাশের পর্যায়ে থাকে। এই করোনা ভাইরাসের মহামারি চলে যাওয়ার পর তাদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটবে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে এবং সর্বোপরি অনেক অভ্যাস পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ, তাদের মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।'

করোনার মহামারির এই সময়ে ঘরে বন্দি অন্তত ১২ জন কিশোরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের মন ভালো নেই। কারণ স্কুল বন্ধ। এভাবে দিনের পর দিন ঘরে থাকতে হবে, তা তাদের কল্পনাতেও ছিল না। পড়াশোনার পাশাপাশি মোবাইল ফোন, কম্পিউটারে গেম খেলছে। কিন্তু খুব মনে পড়ছে বন্ধুদের কথা।

রাজধানীর ডেমরার সামসুল হক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান মোল্লা জানান, ' স্কুল-কলেজ বন্ধ আছে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে। শিক্ষার্থীদের অনেকে আমাদের কাছে ফোন করে বলছে, তাদের মন ভালো নেই। কিছুটা উদ্বিগ্ন তারা। আমরা অবশ্য অনলাইনে আমাদের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছি। আমরা চেষ্টা করছি, কিছুটা হলেও তারা যেন রুটিরে মধ্যে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, করোনার কারণে কিশোর বয়সী যারা ঘরের ভেতর আছে, তারা অবশ্যই মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।'

যেকোন ধরনের মানসিক চাপ মানসিক রোগকে উসকে দেয় বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার। তিনি বলেন, 'সাধারণত ১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে মানসিক রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। আর যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ কিন্তু মানসিক রোগ হতে সাহায্য করে। অনেকের ত্রুটিযুক্ত জিন রয়েছে বা বংশে মানসিক রোগের ইতিহাস রয়েছে। অনেক সময় কিন্তু এগুলো প্রকাশিত হয় না। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে সব বয়সী মানুষ একটা মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। এই মানসিক চাপের কারণে কিন্তু মানসিক রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশিত হতে পারে। যেমন কিশোর বয়সীদের সামাজিক ভীতি কিংবা উদ্বেগজনিত সমস্যা হতে পারে।

অধ্যাপক মেহতাব খানম বলেন, 'ভয় দেখিয়ে কিংবা শাসন করে কিন্তু কোনো লাভ হবে না। বরং এই বয়সের বাচ্চাদের শাসন করলে ওরা কিন্তু আরও বিগড়ে যায়। ওদের সঙ্গে এই পদ্ধতি কাজে লাগে না। ওরা তো আমাদেরই সন্তান। ওরা যদি একটু প্রবেশদ্বার খুলে দেয়, আমরা যেন সেই সুযোগটুকু নিতে পারি।'

হাসান নামের একজন অভিভাবক বলেন, 'আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে। আমাদের এলাকায় অনেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এই খবর আমরা ফেসবুক, অনলাইন পত্রিকা, টেলিভিশনে দেখছি। ছেলেমেয়েরা দেখছে। তারা ভয় পাচ্ছে, আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে। এসব শিশু-কিশোরের মানসিকভাবে সুস্থ রাখার জন্য সরকার যদি প্রচারণ-প্রচারণার ব্যবস্থা করত, তাহলে অনেক লাভ হতো।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, 'স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। সব শিশু-কিশোর এখন ঘরে। এই সময়ে টেলিভিশনে শিশু-কিশোরদের যে ক্লাস নেয়া হচ্ছে, তা মোটেও যথেষ্ট নয়। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। তাদেরকে মানসিকভাবে যদি ঠিক না রাখতে পারি, তাহলে কিন্তু করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের কিন্তু খারাপ পরিণতি হবে।

করোনার কারণে আটকে পড়া শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মনো চিকিৎসকদের উদ্বেগের কথা জানালে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, 'শিক্ষার্থীদের বন্ধ হয়ে যাওয়া পড়াশোনাটা যাতে তারা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তারা যেন ব্যস্ত থাকে, আমরা সেটার ব্যবস্থা করছি। তাদের সুস্থ থাকার জন্য নানা রকম কথাবার্তা বলা হচ্ছে। প্রত্যেকটা টেলিভিশনে স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও প্রত্যেকদিন কোনো না কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে। এখন সংসদ টিভিতে শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলাদা করে পরামর্শমূলক অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়কে বলব।'

জিরোআওয়ার২৪/এমএ  

এই বিভাগের আরও খবর