img

আমাদের যাদের একাধিক বই বের হয় তাদের আবার বইমেলায় গিয়ে শান্তি নেই। যার সঙ্গে দেখা, অবধারিত প্রশ্ন, ‘কয়টা বই?’ প্রথম প্রথম মনে হতো, প্রশ্নকর্তার আমার লেখালেখি নিয়ে কৌতূহল আছে। পরে দেখি, বইয়ের সংখ্যা ছাড়া আর কোনো বিষয়েই এই মানুষগুলোর আগ্রহ নেই। কী লিখলাম, কেন লিখলাম এসব তুচ্ছ। গুরুতর হলো কয়টা বই বেরোল। আর ভঙ্গিটা এমন যেন বেশি বই লেখাতে দেশের সাহিত্যের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। মেজাজটা মাঝেমধ্যে একটু খারাপ হয়; কিন্তু খুব ভেবে দেখলে তাদের দোষ নেই। দোষটা আসলে বইমেলার!

এক বইমেলায় পাঁচ-সাতটা বই খারাপই দেখায়; কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন এগুলো সারা বছরের লেখা এবং বইয়ের মধ্যে আছে পত্রিকায় লেখা কলাম বা পুরনো বইয়ের সংকলনও। সে হিসাবে হয়তো দুটি বা তিনটি নতুন লেখা। এক বছরে এটুকু লেখা তো হতেই পারে। কিন্তু ওই যে বইমেলা ছাড়া প্রকাশিত হয় না। যখনই লেখা হোক না কেন, স্তূপ হয়ে জমে এসে বেরোয় ঠিক বইমেলার সময়। তাতে অল্পবিস্তর চাহিদা আছে এমন লেখকদের একগাদা বই। প্রশ্ন উঠতেই পারে।

এই মেলাসর্বস্বতার সমস্যা নিয়ে একবার এক ঘনিষ্ঠ প্রকাশকের সঙ্গে আলাপ করলাম। আলাপে রাজ্য জয় করা খুব কঠিন ব্যাপার নয়। এক সন্ধ্যায় দুজনই একমত হয়ে গেলাম, পুরোপুরি বইমেলামুখী হয়ে যাওয়াটা খুবই খারাপ। বছরের মাঝখানে একটা বই প্রকাশ করে দেখিয়ে দিতে হবে যে...। উত্তেজনায় ঈদ সংখ্যার একটা লেখা বর্ধিত করে তখনই দিয়ে দিলাম। প্রকাশক পাঠালেন প্রুফ রিডারের কাছে; কিন্তু প্রুফ থেকে বই আর আসে না। আমি তাগাদা দিই। প্রকাশক তাড়া দেন; কিন্তু প্রুফ রিডারের সাড়া নেই। একদিন শেষে দুজন মিলিতভাবে ধরলাম প্রুফ রিডারকে।

প্রকাশকের গর্জন, ‘এক মাস হয়ে গেল। একটা ছয় ফর্মার বইয়ের প্রুফ দেখা হয় না!’

‘এই জুন মাসে প্রুফ দিয়ে কী করবেন?’

‘বই বের করব।’

‘বই বের করবেন! এটা তো আগামী মেলার বই।’

‘কে বলল আগামী মেলার। এখনই...’

প্রুফ রিডার একটু অবাক হয়ে বইয়ের সামনের পাতাটা বের করে দেখালেন, যাতে প্রকাশকালের জায়গায় পরের বছরের বইমেলার তারিখ দেওয়া। প্রকাশক বিস্মিত। রহস্য বের হতে সময় লাগল না। তাঁর নিজের অফিসের কম্পোজিটরও ধরেই নিয়েছেন, আগামী মেলার বই। কাজেই পরের বছরের ফেব্রুয়ারির তারিখটা বসিয়ে দিয়েছেন। প্রুফ রিডারও তাই ধরছেন পরের মেলার বই।

আসলে বছরের মাঝখানে বই করতে গেলেও কেউ মানতেই চায় না এই সময় বই বের হবে। বের করেই বা লাভ কী! এই সময়ে পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় বই নিয়ে আয়োজন নেই। টিভিতে লাইভ নেই। প্রচারিত হবে না। কেউ জানবে না। প্রকাশকের বিনিয়োগটা গুদামে পড়ে থাকবে। বইমেলা তাই একই সঙ্গে আশীর্বাদ এবং অভিশাপও। আশীর্বাদ, কারণ বইমেলার আয়োজনের রঙের কারণে বই এই পর্যায়ের প্রচার পায়। আবার অন্যদিকে প্রচার-প্রচারণা সব বইমেলা ঘিরে ঘটে বলে অন্য সময় কেউ বই বের করতে চায় না। মেলার সময় শুনবেন বিদগ্ধজনরা তীব্র সমালোচনা করে বলেন, মেলাকেন্দ্রিক এই প্রকাশনা সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সবাই শোনে; কিন্তু কিছু যে হয় না এর কারণ বোধ হয় শেষ পর্যন্ত মেলার এই রং এবং ধরনটা আসলে আমাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে আছে।

বইমেলার সঙ্গে আমার এই সম্পর্কের প্রায় আড়াই দশক। সেই সম্পর্কে আনন্দের সুঘ্রাণ আছে। আছে ভ্রান্তির কাঁটাও। খেলা নিয়ে কাজের জগত্টা অনেক বিস্তৃত বলে আমার বই মানেই পাঠকদের বড় একটা অংশ ধরে নেয় খেলার বই। শুরুতে অবশ্য খেলা নিয়ে উপন্যাসও লিখেছিলাম বেশ কিছু। খেলা নিয়ে রিপোর্ট করতে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই, বড় পত্রিকায় নিয়মিত নাম ছাপা হয়, অল্পবিস্তর মানুষ তাই চিনে ফেলল। তাদের ওপর ভরসা করে ক্রিকেট নিয়ে লিখলাম একটা উপন্যাস। লিখে মনে হলো, ফাটিয়ে দিয়েছি; কিন্তু বাস্তবে নিজেই ফেটে যাওয়ার জোগাড়। বই মানুষ নেড়েচেড়ে দেখে, কেনে না। খেলার মানুষেরা বলে, ‘দূর, এটা খেলার বই না। উপন্যাস।’ আবার উপন্যাসের পাঠকরা বলে, ‘দূর, এটা তো উপন্যাস না। খেলার বই।’ এই বিভ্রান্তিতে আরো এক-দুই দফা চেষ্টা করে বাদই দিলাম সেই পথ। আরেকটা কারণও আছে। কিভাবে কিভাবে যেন পাশাপাশি লেখা কিশোর উপন্যাসগুলো বাচ্চাদের বেশ পছন্দ হয়ে গেল। বড়দের উপন্যাসও মনোযোগ পেল কিছুদিন পর। সত্যি বললে, ক্রীড়া সাহিত্যিক হিসেবে ব্যর্থতাই আমাকে অন্য ক্ষেত্রের উপন্যাসের দিকে ঠেলেছে। তবু নিজের জায়গা বলে কথা; অনেক বছর পর আবার ক্রিকেট নিয়ে লিখেছি উপন্যাস। ১৫-১৬ বছর আগের উপন্যাসগুলোতে খেলোয়াড় আর খেলা নিয়ে স্বপ্নের কথাই বেশি ছিল। অল্প বয়সে চোখে থাকে শুধুই স্বপ্ন। বয়স হলে অভিজ্ঞ চোখে স্বপ্নের কুফলও ধরা পড়ে। এবারের ক্রিকেট নিয়ে লেখা উপন্যাসে সেই দিকটা আছে। খেলাকে নিয়ে পেছনে যে খেলা চলছে, ক্রিকেটকে যে সবাই মিলে চেপে ধরে মেরে ফেলতে বসেছি, ‘ম্যাচের আগের দিন’ উপন্যাসটা সেই প্রেক্ষাপট ধরেই লেখা। বেরিয়েছে অনন্যা থেকে, সেখানে আছে আরো একটি বই, ফ্রেন্ডস ক্লাব সিরিজের তিনটি উপন্যাস একসঙ্গে, ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব আনলিমিটেড’। আছে পার্ল পাবলিকেশনস থেকে বেরোনো কিশোরদের জন্য নতুন ভৌতিক উপন্যাস ‘প্যাকেট নিয়ে পাগলামি’ এবং গোয়েন্দা তনু কাকা সিরিজের নতুন বই, ‘রাজবাড়ির অন্ধকারে’। সঙ্গে ‘কিশোর গল্পসমগ্র’। বর্ষাদুপুর বের করেছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর উপন্যাস, ‘লিডার রবি’। এর সঙ্গে আরো কিছু পুরনো বইয়ের নতুন চেহারায় উপস্থিতি।

নতুন এসব বইয়ের সঙ্গে আছে নতুন একটা অভিজ্ঞতাও। ক্রিকেটের উপন্যাসটাকে এবার নাকি দুই পক্ষই নিজেদের বলে ভাবছে। ক্রিকেটপ্রেমীরা বলছে, আরে এটা ক্রিকেটের বই। সাহিত্যপ্রেমীরা বলছে, আরে এটা তো উপন্যাস।

এই বিভাগের আরও খবর