চাঁদে যাওয়া নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার লড়াই চলে যেভাবে
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ ১৯৫৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক এক সফরে ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন।
হোয়াইট হাউজে তিনি দেখা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেনাওয়ারের সাথে। সেসময় তিনি তাকে গোলকাকৃতি একটি বস্তু উপহার দেন যাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতীক খোদাই করা ছিল।
লুনা ২ মিশনে ঠিক এরকমই একটি গোলাকার যান চাঁদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এটিই ছিল প্রথম মহাকাশ যান যা চাঁদের পৃষ্ঠ স্পর্শ করেছিল, এবং এই উপহারটি দেওয়া হয়েছিল এই ঐতিহাসিক ঘটনার মাত্র একদিন আগে।
চাঁদে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় রাশিয়া এরপর আরো দু'বার আমেরিকাকে পরাজিত করে। কিন্তু তার পরেই মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা চাঁদে পাঠিয়েছিল এপোলো ১১ যা প্রথমবারের মতো সেখানে মানুষ নিয়ে গিয়েছিল।
সেটা ১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই এর ঘটনা।
মহাকাশে প্রতিযোগিতা
পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল ১৯৫৭ সালে যখন রাশিয়া তার কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক উৎক্ষেপণ করেছিল।
ছবির কপিরাইটNASA
Image captionলুনা ২ মিশনের একটি মডেল।
প্রথম চাঁদে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে এই দৌড়ে এগিয়ে যায় রাশিয়া।
এর পরে রাশিয়ার লুনা ৯ মহাকাশ যান ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আরো একবার চাঁদে সফ্ট ল্যান্ডিং (সফল অবতরণ) করেছিল। সেসময় ওই যান থেকে প্রথমবারের মতো চাঁদের উপরি-পৃষ্ঠের একটি ছবি তোলাও সম্ভব হয়েছিল।
এর দু'মাস পর লুনা ১০ নামে আরো একটি মিশন পাঠায় রাশিয়া। এটিই ছিল প্রথম কোন মহাকাশ যান যা চাঁদের কক্ষপথে স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল।
চাঁদের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গবেষণায় সহায়ক হয়েছিল ওই মিশন।
নাসার একজন প্রকৌশলী জন হবোল্ট ১৯৬১ সালে লুনার অরবিট রঁদেভু বা এলওআর নামের একটি মিশনের প্রস্তাব করেন। বলা হয় ওই মিশনে থাকবে একটি মাদার শিপ (বড় যান) যা চাঁদের কক্ষপথে অবস্থান করবে এবং তার ভেতর থেকে ছোট একটি মহাকাশ যান বের হয়ে সেটি চাঁদে গিয়ে অবতরণ করবে।
হবোল্ট বলেছিলেন, এই এলওআর মিশনের মাধ্যমে সময় ও জ্বালানী দুটোরই সাশ্রয় ঘটবে, মহাকাশ অভিযানের বহু জটিল স্তর সহজ হয়ে যাবে। এসবের মধ্যে রয়েছে - যান তৈরি, পরীক্ষা, উৎক্ষেপণ, ক্ষণ-গণনা এবং ফ্লাইট পরিচালনা।
এসব বিজ্ঞান ব্যবহার করেই আমেরিকা চাঁদে পৌঁছাতে পেরেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬৬ সালে পৃথিবীর এই উপগ্রহটি জয় করার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।
"একজন মানুষের চাঁদে নামার আগে সেখানে একটি যান বা রোবটকে অবতরণ করাতে হবে। কিন্তু আমরা যেন সবাই সোভিয়েত ইউনিয়নের এসব সাফল্যকে ভুলে যেতে চাই," বলেন লন্ডনে বিজ্ঞান যাদুঘরের কিউরেটর ডগ মিলার্ড।
ছবির কপিরাইটNASA
Image captionচাঁদের পৃষ্ঠের প্রথম ছবি, ১৯৬৬ সালে তোলা।
লুনা ২
সোভিয়েত ইউনিয়নের গোলকাকৃতি মহাকাশযানটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ১৯৫৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর।
সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ সেসময় আরো একটি অস্বাভাবিক কাজ করেছিল। এই মিশনের যথেষ্ট গোপনীয়তা সত্ত্বেও তারা এর গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী বার্নার্ড লোভেলের সাথে শেয়ার করেছিল। এমনকি এর গতিপথ সম্পর্কেও তাকে জানানো হয়েছিল।
এই বেরনার্ড লোভেলই বিশ্বের সব পর্যবেক্ষকদের এই মিশনের সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত করেছিলেন। এমনকি আমেরিকানদেরকেও, যারা প্রথমে সোভিয়েতের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
লুনা ২ চন্দ্রপৃষ্ঠে যখন আছড়ে পড়ে - তখন তার গতি ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১২,০০০ কিলোমিটার। মস্কোর স্থানীয় সময় হিসেবে তখন ১৪ই সেপ্টেম্বর মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে।
এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা চলে যে এত দ্রুত গতিতে চাঁদের পিঠে নামার কারণে এই যানটি নিশ্চয়ই অক্ষত ছিল না।
কিন্তু এই মিশনটিই শীতল যুদ্ধের উত্তাপ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ছবির কপিরাইটKANSAS COSMOSPHERE
Image captionলুনা ২ মিশনের একটি নমুনা যা সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্টকে উপহার দিয়েছিলেন।
লুনা ২ বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালিয়েছিল। যেমন: চাঁদে দেখা যায় কিম্বা অনুভব করা যায় এরকম পরিমাপযোগ্য চৌম্বকীয় ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড নেই, এই মিশনে চাঁদে রেডিয়েশন বেল্টের কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
"উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই মিশন বিজ্ঞানীদেরকে চাঁদের ভূতত্ত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারণা দিয়েছে," - বলেন যুক্তরাজ্যের পদার্থবিজ্ঞানী লিবি জ্যাকসন। ব্রিটিশ মহাকাশ সংস্থার হিউম্যান এক্সপ্লোরেশন প্রোগ্রামেরও ম্যানেজার তিনি।
লুনা ৯
সাত বছর পর পাঠানো হয় লুনা ৯ নামের আরো একটি মহাকাশ যান - যা আসলে এপোলো প্রোগ্রামকে সাহায্য করেছিল।
এটি চাঁদে অবতরণ করার আগে সোভিয়েত ও আমেরিকার বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন চন্দ্রপৃষ্ঠ এই যানটির জন্য খুব নরম হবে। এমন আতঙ্কও ছিলো যে চাঁদের পিঠে হয়তো ধুলোবালি দিয়ে ঢাকা - যার ভেতরে যেকোনো ল্যান্ডার নামামাত্রই মাটিতে ডুবে যেতে পারে।