img

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় মোট ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করেছে পিবিআই; মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে সেখানে করা হচ্ছে হুকুমের আসামি।

সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত এ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র বুধবার আদালতে জমা দেয়ার আগে মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এ তথ্য জানান।

ধানমন্ডিতে নিজের কার্যালয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার বলেন, নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনায় সরাসরি পাঁচজনের জড়িত থাকার বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।

'ওই পাঁচজন এবং সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ মোট ১৬ জনকে আসামি করে বুধবার আদালতে এ অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।'

পিবিআই প্রধান বলেন, অভিযোগপত্রে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আসামি করা হচ্ছে নুসরাতকে হত্যার 'হুকুমদাতা' হিসেবে। তার নাম থাকছে আসামির তালিকার ১ নম্বরে।

এছাড়া ওই মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন এবং সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম ওই হত্যাকান্ড বাস্তবায়নে আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন বলে উলেস্নখ থাকছে পিবিআইয়ের অভিযোগপত্রে। 

সেখানে বলা হচ্ছে- 'তদন্তে মোট ১৬ জন আসামির বিরুদ্ধে নুসরাত জাহান রাফিকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা এবং হত্যার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ ও হত্যাকান্ডে সহযোগিতা করার অপরাধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৪(১) ও ৩০ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।'

এই তদন্তের ভিত্তিতে পিবিআই অভিযোগপত্রে ১৬ আসামির সবার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃতু্যদন্ড চাইবে বলে বনজ কুমার মজুমদার জানান। 

সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছিলেন চলতি বছরের আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত। গত ২৬ মার্চ নুসরাতের মা শিরীনা আক্তার মামলা করার পরদিন সিরাজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ওই মামলা প্রত্যাহার না করায় ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার হল থেকে মাদ্রাসার একটি ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন দেয় বোরখা পরা কয়েকজন। আগুনে শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নুসরাত ১০ এপ্রিল রাতে হাসপাতালে মারা যান।

নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার পর ৮ এপ্রিল তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান অধ্যক্ষ সিরাজকে প্রধান আসামি করে ৮ জনের নাম উলেস্নখসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের আরও ৪/৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছিলেন।

নুসরাতের মৃতু্যর পর তা হত্যামামলায় রূপান্তরিত হয়। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আর দেশজুড়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মধ্যে মামলার তদন্তভার থানা পুলিশ থেকে দেয়া হয় পিবিআইয়ের হাতে।

মৃতু্যর আগে হাসপাতালে পুলিশকে দেয়া জবানবন্দিতে নুসরাত তার গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে যান। পরে আসামিরা একে একে গ্রেপ্তার হতে থাকে, আদালতে তাদের দেয়া জবানবন্দি থেকে হত্যাকান্ডের আদ্যোপান্ত জানতে পারেন তদন্তকারীরা।

অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা কারাগারে থেকেই নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন বলে উঠে আসে পিবিআইয়ের তদন্তে।

আসামি হচ্ছেন যারা

১. সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, ২. নূর উদ্দিন, ৩. শাহাদাত হোসেন শামীম, ৪. সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম, ৫. সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, ৬. জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, ৭. হাফেজ আব্দুল কাদের, ৮. আবছার উদ্দিন, ৯. কামরুন নাহার মনি, ১০. উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, ১১. আব্দুর রহিম শরীফ. ১২. ইফতেখার উদ্দিন রানা, ১৩. ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, ১৪. মোহাম্মদ শামীম, ১৫. মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন, ১৬. মহিউদ্দিন শাকিল।

এই ১৬ আসামির মধ্যে নুসরাতের তিন সহপাঠী কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ও জাবেদ হোসেন ছাড়াও শাহাদাত হোসেন ও জোবায়ের আহমেদ হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নেন বলে উঠে এসেছে আসামিদের জবানবন্দি ও পিবিআইয়ের তদন্তে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট চারটি গ্রম্নপে ভাগ হয়ে আসামিরা কাজ করেছে। নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার পর তার তিন সহপাঠী পরীক্ষার হলে ঢুকে আলিম পরীক্ষাও দিয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক শাহ আলম তার ৭২২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের আসামি করছেন, তাদের সবাই ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের মধ্যে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১২ জন আদালতে ১৬৪ ধরায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এ মামলার বাদী নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানসহ মোট ৯২ জনকে অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হচ্ছে। তার মধ্যে সাতজন আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।

নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার জন্য কেরোসিন তেল বহনের কাজে ব্যবহৃত পলিথিন, নুসরাতের গায়ে সেই কেরোসিন ছিটানোর কাজে ব্যবহৃত একটি কাচের গস্নাস, দেশলাইয়ের কাঠি, তিনটি কালো রঙের বোরখা, আসামি শামীমের ব্যবহৃত একটি মোবাইল ফোন, আসামি রুহুল আমীনের সঙ্গে তার কথপোকথনের রেকর্ড এবং অধ্যক্ষের অপকর্মের বিবরণ লেখা নুসরাত জাহান রাফির ডায়েরি এ মামলার আলামত হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হবে।

পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, 'নুসরাত মাদ্রাসার সব অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। তাই সবাই মিলে নূসরাতকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে, পরস্পর লাভবান হওয়ার জন্য। আমরা ১৬ আসামির সবার মৃতু্যদন্ড প্রত্যাশা করছি।'

এই বিভাগের আরও খবর