img

মারিসা মুজেল কন্যা সন্তানের জন্ম দেবার জন্য ১৬ ঘন্টা প্রসব বেদনা সহ্য করেছেন। তার আরো কিছু গর্ভকালীন সমস্যা ছিল – যার জন্য তাকে দুবার হাসপাতালে থাকতে হয়, প্রতি মাসে হর্মোন ইনজেকশন নিতে হয়। কারণ এর আগে তার চার বার গর্ভপাত হয়েছিল। তিনি এ কষ্ট সহ্য করেছেন এমন এক শিশুর জন্ম দেবার জন্য – যে তার নিজের সন্তান নয়। এই সন্তানটির অভিভাবক হবেন স্পেনের একটি পুরুষ সমকামী দম্পতি। এই দম্পতির একজন পুরুষের শুক্রাণু এবং এবং একজন দাতা নারীর ডিম্বাণু থেকে কন্যাশিশুটির জন্ম হয়েছে।

৩২ বছর বয়স্ক মারিসা কানাডায় একজন সারোগেট মা । এখানে শত শত এরকম নারী আছেন যারা আত্মীয় নন এমন লোকেদের সন্তান জন্মের জন্য নিজের গর্ভ ব্যবহার করতে দেন। “আমি অন্য কারও জন্য পরিবার গড়ে দিচ্ছি” বলছেন মারিসা। বিশ্বে এখন সারোগেট মা, বিশেষ করে কানাডিয়ান মায়ের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। যারা এভাবে সন্তান চাইছেন – তাদের অনেকের গন্তব্য এখন কানাডা। প্রগতিমুখী এই দেশটিতে গত এক দশকে সারোগেট মায়ের সংখ্যা ৪০০ গুণ বেড়েছে। তবে এখানে যে নারীরা সারোগেট মা হন – তারা এ থেকে কোন অর্থনৈতিক লাভ করতে পারেন না। তা ছাড়া কানাডার আইন এমন যে – কানাডায় অনেক সহজে সারোগেট শিশুদের আইনী অভিভাবকত্ব পাওয়া যায়, এবং সমকামী দম্পতি বা একজন নারী বা একজন পুরুষও এই সুযোগ পেতে পারেন।

 

যেসব দেশে বাণিজ্যিকভাবে গর্ভ-ভাড়া দেয়া হয় – সেখানকার চাইতে কানাডার খরচও কম। “আমি দেখেছি অনেক আমেরিকান সারোগেট মা আছে যাদেরকে গর্ভবতী হবার সাথে সাথেই হাজার হাজার ডলার দিতে হয়। কানাডায় আমরা এরকম করি না” – বলছেন মারিসা। কানাডায় সারোগেট মায়েরা শুধু গর্ভাবস্থা-সংক্রান্ত খরচ মেটানোর অর্থ পান – কিন্তু তার একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। এর মধ্যে ওষুধপত্র, কাপড়চোপড়, বাজার-সওদা, যাতায়াত ইত্যাদি খরচ থাকে। তা ছাড়া কেউ যদি কাজে যেতে না পারেন, তাহলে তার হারানো বেতনও তিনি পেতে পারেন। প্রতিটি খরচের জন্য তাকে দলিলপত্র দিতে হয়। “এটা এমন কোন আয় নয় যা থেকে আপনি সঞ্চয় করতে পারেন । আমার সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র নই। আপনি এ কাজ করছেন মমত্ববোধ থেকে, চাকরি হিসেবে নয়” – বলছিলেন মারিসা, যিনি পেশায় একজন যুব কর্মী।

অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন যে সারোগেট মা বিষয়টা আধুনিককালের একটা জিনিস। কিন্তু আসলে তা নয়। এক দম্পতির সন্তান ধারণের জন্য অন্য এক মহিলাকে ব্যবহার করা – প্রাচীন ব্যাবিলনেও ছিল। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি একেবারে অন্য স্তরে নিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে যা হয় তাহলো: সারোগেট মা কখনো তার নিজের ডিম্বাণু থেকে সৃষ্ট শিশু ধারণ করেন না। ডিম্বাণু আসে অন্য এক নারীর দেহ থেকে। অভিভাবক হতে ইচ্ছুক পুরুষের শুক্রাণুর সাথে ডিম্বাণুর নিষিক্তকরণ ঘটে ল্যাবরেটরিতে । আর সেই নিষিক্ত ভ্রুণটি স্থাপন করা হয় সারোগেট মহিলার জরায়ুতে। কানাডায় সারোগেট মায়েদের ক্লাব আছে, যেখানে তারা একসাথে হতে পারেন, অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারেন। ধারণা করা হয় যে কানাডায় আছেন কমপক্ষে ৯০০ সক্রিয় সারোগেট মা। একটি সারোগেসি এজেন্সির প্রতিষ্ঠাতা লেইয়া সোয়ানবার্গ বলছেন, এগারো বছর আগে এই কোম্পানি শুরুর সময় আমাদের ৮টি শিশুর জন্ম হয়। এখন শুধু গত এক মাসেই আমরা ৩০টি শিশুর জন্ম দিয়েছি।

এটা অনেকটা অনলাইন ডেটিংএর মত। সারোগেট মায়েরা নিজস্ব প্রোফাইল জমা দেন। অভিভাবক হতে ইচ্ছুক যারা তারাও প্রোফাইল পাঠান। তার পর পরস্পরের যোগাযোগ এবং পছন্দের ভিত্তিতে ব্যাপারটা চূড়ান্ত হয়। শিশুর জন্মকে কেন্দ্র করে তারা অচেনা লোক হিসেবে শুরু করেন – কিন্তু পরে পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠেন । তবে এ পথ কঠিন। অনেক সময় একাধিকবার আইভিএফ করাতে হয়, গর্ভপাতও ঘটে প্রায়ই। এর অনেক সমালোচকও আছেন। অনেকে একে নারীর শোষণ এবং বেশ্যাবৃত্তির সাথে তুলনা করেছেন, এটা নিষিদ্ধ করার দাবিও তুলেছেন। কিন্তু কানাডায় যেহেতু এটা থেকে সারোগেট মা অর্থ আয় করতে পারেন না – তাই এ সমালোচনাকে সঠিক মনে করেন না এর সমর্থকরা। সারোগেট মায়েদের শুধু গর্ভধারণের খরচটাই দেয়া হয়। এর সাথে সংশ্লিষ্ট এজেন্সি, ডাক্তার, আইনজীবী ও ক্লিনিক – তারা তাদের ফি পান। এই খরচ কম নয়। এতে একজন সন্তানকামী দম্পতির ৫৭ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত লাগতে পারে।

এতে কোন ক্ষতিপূরণ দেয়াও নিষিদ্ধ। সারোগেট মা-কে এমন কি ফুল পাঠালেও তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হতে পারে। এ সংক্রান্ত কোন আইন ভাঙা হলে ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা এবং দশ বছরের কারাদন্ড হতে পারে। অবশ্য এসব আইন শিথিল করার দাবিও তুলছেন অনেকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো : তাহলে সারোগেট মায়েরা গর্ভে অন্যের সন্তান ধারণ করে তাহলে কি পান? অনেকে এটা করেন সন্তান পেতে অক্ষম কোন পরিবারকে সাহায্য করার মানসিকতা থেকে। কারো কাছে এটা এক ধরণের এ্যাকটিভিজম – তারা এলজিবিটি অর্থাৎ পুরুষ ও নারী সমকামী, উভকামী, এবং লিঙ্গপরিবর্তনকারীরা যাতে সন্তান পেতে পারে সে জন্য কাজ করছেন বলে মনে করেন। এরা মনে করেন, সারোগেট মা হওয়া এবং কোন অভিভাবককে সন্তান উপহার দিতে পারা একটা গর্বের বিষয়।-বিবিসি বাংলা

এই বিভাগের আরও খবর