img

আগামী ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এই নির্বাচনকে দেখা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ততই বেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের দাবি জোরালো করছে। তাদের আশা এসব পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ওপর চাপ বাড়াবে। জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষমতা নিয়ে দেশের ভিতরে ও বাইরে সংশয় আছে। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ তৈরি করে দিতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন নামমাত্র স্বাধীন। ক্ষমতাসীনদের লাইন থেকে তাদের বিচ্যুত হওয়ার ঘটনা বিরল। সব সময়ই তারা ক্ষমতাসীন দলের অনুগত হয়ে কাজ করে। তাই কর্মকর্তাদের মধ্যে নিরপেক্ষতার ধারণা বদ্ধমূল করতে বিরোধীরা বার বার আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সহায়তা চেয়েছে।
বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধীরা দাবি করেছে, নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে। ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। বিরোধী রাজনীতিকরা বলেন, একটি ‘নিরপেক্ষ’ প্রশাসন নিশ্চিত করবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, যাতে সব দল নির্বাচনে প্রতিদ্বিন্দ্বতা করতে পারে। কিন্তু তাদের এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে ক্ষমতাসীন দল ও দলটির নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও একই দাবি করেছিল বিরোধীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করায় বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করে। এতে সহিংসতায় নির্বাচন বিঘ্নিত হয়। কিন্তু এবার তাদের দাবি না মানা হলেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
গত ১৫ই নভেম্বর ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বাংলাদেশ ইস্যুতে একটি প্রস্তাব পাস করেছে। তাতে একটি শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এতে দেশবাসীকে তাদের ‘প্রকৃত রাজনৈতিক পছন্দ’ বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে এর মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনশীল। এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে কোনো পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তে অটল আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর নেপথ্য কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের একজন সদস্য জোসেফ উইডেনহোলজার। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিবিড়ভাবে নজর রাখছেন।
তিনি বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে যেসব মৌলিক অধিকার থাকার কথা, যেমন বিনা বাধায় সমাবেশ করা, মিডিয়ার স্বাধীনতা ইত্যাদি, বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ সেই অধিকার প্রদর্শন করে না। বিরোধীদের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। সুষ্ঠু বিচারে যা যা প্রয়োজন তা থেকে ঘাটতি আছে এমন এক বিচারে তাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে দেয়া হয়েছে ১০ বছরের জেল। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। এমন সব পরিস্থিতিতে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের মিশনের উপস্থিতি তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না এবং তাদেরকে বিকৃত উদ্দেশে অপব্যবহার করা হতে পারে।
এর আগে ডয়েচে ভেলেকে একটি সাক্ষাৎকার দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেনজি তিরিঙ্ক। তিনি ওই সাক্ষাৎকারে হাতে সময় কম থাকার কথা বলেন। এ ছাড়া বাজেট ও নিরাপত্তাকে তিনি এবারের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশেই স্থানীয় পর্যায়ের অনেক ভালো পর্যবেক্ষক আছেন। তারাই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে চমৎকার কাজ করবেন হয়তো।
বিশ্লেষকরা বলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এমন সিদ্ধান্ত উদ্বেগের। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, যেহেতু ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের অনেক সদস্য ১৫ই নভেম্বর দৃঢ়তার সঙ্গে আসন্ন নির্বাচনকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, এটাই হলো দেশটির গণতান্ত্রিক গতিধারা ও আইনের শাসন নির্ধারণের শেষ সুযোগ। তাই সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করা উচিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের এবং তা করা উচিত অবিলম্বে। আলি রীয়াজ বলেন, মানবাধিকার, সুশাসন ও গণতন্ত্রের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই বাজেটের টানাপড়েনের কথা বলে তারা সেই অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে না।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উড্র উইলসন সেন্টার ফর স্কলারসের মাইকেল কুগেলম্যানের কণ্ঠেও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। তিনি বলেন, সুস্পষ্টভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কারণ, তারা ধরে নিয়েছে নির্বাচন এতটাই অবাধ ও সুষ্ঠু হবে যে, সেখানে পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি হবে অতিরিক্ত। এটাকে আমি এমন একটি ইঙ্গিত হিসেবে দেখি যাতে মনে হয়, এই নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এতটাই সন্দেহপ্রবণ যে, তারা এতে পর্যবেক্ষক পর্যন্ত পাঠানোর কথাও ভাবছে না। উপরন্তু, এ বিষয়টিতে সিদ্ধান্তে যাওয়া হতে পারে একটি অত্যন্ত বিরক্তিকর বিষয়।
অতীতে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে শক্তিশালী পর্যবেক্ষক টিম পাঠিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৫৯৩ জন আন্তর্জাতিক ও ১৫ লাখ ৯ হাজার ১১৩ জন স্থানীয় পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন।
ওই নির্বাচনে যেসব বিদেশি পর্যবেক্ষক এসেছিলেন তার বেশির ভাগই পাঠিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ওই নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণমূলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগ। তারপর থেকেই দেশ শাসন করে চলেছে এই দলটি। কিন্তু ২০১৪ সালের একপেশে নির্বাচন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

এই বিভাগের আরও খবর