img

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কিছু বাকি। এমনি সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশে তার ভাষায় ‘ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধ’ মোকাবিলার জন্য ইন্টারনেটের (সামাজিক মাধ্যমের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে) তদারকি ও নজরদারি জোরদার করেছে।

বাংলাদেশ পুলিশ ও এর বৃহত্তম শাখা (রাজধানীর আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ তথা ডিএমপি) সাইবারস্পেসের অপরাধীদের মোকাবিলার জন্য জনশক্তি ও কম্পিউটার হার্ডওয়্যার দিয়ে বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর কার্যক্ষমতা বাড়াচ্ছে।

 

এতে সাধারণ মানুষের প্রাইভেসি ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য স্বাধীন মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টির শঙ্কা বাড়ছে।

এদিকে পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) নির্বাচনের অন্তত চার মাস আগে থেকে সামাজিক মাধ্যম নজরদারি করার বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

আমলাদের ওপরও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা গুজব ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রপাগান্ডা শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য নির্বাচনী হুমকি কঠিন চ্যালেঞ্জ মনে হচ্ছে।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের (পিআইডি) কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ৯ সদস্যের তদারকি সেল ফেসবুক ও টুইটারসহ অনলাইন প্লাটফর্মগুলো সার্বক্ষণিক নজরদারি করবে। তারা যেসব গুজব বা রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট শনাক্ত করতে পারবে, সেগুলো পরিশোধন বা ব্লক করার জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের কাছে পাঠাবে।

পুলিশ ইউনিটগুলোর শক্তি বাড়ানো

দেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ সরকার গত দশকে বেশ কয়েকটি বিশেষায়িত সাইবার অপরাধ পুলিশ ইউনিট গঠন করেছে।

বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) রয়েছে সাইবার অপরাধ তদন্ত সেল ও আইটি ফরেনসিক ল্যাব।

বাংলাদেশ পুলিশের আরেকটি বিভাগ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাইবার ক্রাইম ইউনিট নামে একটি বিভাগ রয়েছে। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব সাইবার ইউনিটকে একত্রিত করে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (সিসিআইবি) নামে একটি ইউনিট গঠন করেছে।

এশিয়া টাইমসকে সিসিআইবির স্পেশাল সুপারিনটেন্ডেন্ট বলেন, বিভিন্ন ইউনিট তাদের কাজে সমন্বয়ের অভাব বোধ করায় একটি নতুন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সাইবার ক্রাইমের মতো জটিল ইস্যুগুলো মোকাবিলা করার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি-সংবলিত কেন্দ্র প্রয়োজন। এটি কেবল সামাজিক মাধ্যম তদারকি করা ও রাষ্ট্রবিরোধী বা সরকারবিরোধী প্রপাগান্ডার জন্যই দরকার নয়। আমাদের নতুন কেন্দ্রটি আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হুমকি বা লঙ্ঘনের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখবে।

এদিকে ঢাকা পুলিশ তাদের ছোট মাত্রার সাইবার সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টকে অনেক বড় সোস্যাল মিডিয়া মনিটরিং অ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি ডিভিশনে পরিণত করেছে।

এপ্রিল থেকে দেশটি ছাত্রদের নেতৃত্বে বারবার অস্থিরতায় নিমজ্জিত হয়েছে। এপ্রিল ও মে মাসে সরকারের চাকরি কোটার বিরুদ্ধে কয়েক বার প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আগস্টে ছাত্ররা প্রতিবাদ করে।

উভয় আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সামাজিক মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে অনেক গুজবও ছড়ানো হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। কর্তৃপক্ষ এর জবাবে অন্তত ১০০ জনকে গ্রেফতারসহ বেশ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

নতুন ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ

ইন্টারনেটের ওপর নজরদারি জোরদার করার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ ও ঢাকা পুলিশ উভয়কেই নতুন সরঞ্জাম প্রদান করা হয়েছে।

সিসিআইবির এক কর্মকর্তার মতে, তারা ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল সাবস্ক্রাইবার আইডেন্টিটি (আইএমএসআই), মনিটর-মোবাইল ট্র্যাকার্স ব্যাক প্যাক আইএমএসআই মনিটর-লোকেশন ফাইন্ডার সংগ্রহ করছে।

সিসিআইবি ওপেন সোর্স ইন্টিলিজেন্স (ওএসআইএনটি) মনিটরও সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। এগুলো আধুনিক গোয়েন্দা সরঞ্জাম। এগুলো সামাজিক মিডিয়া নেটওয়ার্কসহ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করার বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে।

পরিকল্পনা কমিশন ওয়েব নজরদারির লক্ষ্যে র‌্যাবের বিশেষ হার্ডওয়্যার ও সফটওয়ার কেনার জন্য ১৩.৯ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প অনুমোদন করেছে। প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, র‌্যাব ইতোমধ্যেই একটি ওয়াইফাই ইন্টারসেপ্টর, একটি লেজার লিসেনিং ডিভাইস ও একটি আন্ডার ডোর ভিউয়ারের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে।

গত ১২ জুন বাংলাদেশ সরকার ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের মোবাইল ফোন, ইমেইল ও সামাজিক মিডিয়া নজরদারির জন্য ২৮ মিলিয়ন ডলারের সরঞ্জাম কেনার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে।

প্রাইভেসি নিয়ে উদ্বেগ

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জাব্বার বলেন, সাইবার ক্রাইম দমনের জন্য প্রায় সব দেশই ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ এমন কিছু রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, যা অন্যান্য দেশ হয়তো পড়ছে না। এ কারণে আমাদের ওয়েব স্পেসে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে নজরদারি প্রয়োজন। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ, গুজব, প্রপাগান্ডার হুমকি রয়েছে। এছাড়া নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় এসব হুমকি বাড়তে পারে। ফলে আমাদের প্রয়োজনের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।

তবে পরিচয় গোপন রাখতে ইচ্ছুক এক সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকারের ক্রমবর্ধমান হারে ইন্টারনেট নজরদারি বাড়ানোর কারণ হলো নির্বাচনকে সামনে রেখে সমালোচক ও ভিন্ন মতালম্বীদের মুখ বন্ধ রাখা।

তিনি বলেন, কেবল গুজব ছড়ানো ও সরকারবিরোধী বক্তব্য পোস্ট করাকেই সরকার সাইবার অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকে যে বড় ধরনের আর্থিক সাইবার-ক্রাইম হয়েছে, সে ধরনের আরেকটি ঘটনা আইন প্রয়োগকারীরা প্রতিরোধ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর