img

টনাটি ৪২ বছর আগের—১৯৭৬ সালের। ঢাকার মগবাজারে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল দুই বছরের এক শিশু। মাথায় আঘাত পাওয়া শিশুটিকে তুলে নিয়ে পাশের হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন একজন। শিশুটির নাম যেহেতু জানার উপায় ছিল না, তাই পরিচয় হিসেবে খাতায় লেখা হয় ‘বেবি পাওয়ার’। চিকিৎসায় ভালো হয়ে ওঠার পর শিশুটি আধো আধো বোলে তার নাম বলে ডালিয়া।

ওই বছরই অভিভাবকহীন এই শিশুটিকে দত্তক নেয় ডেনমার্কের একটি পরিবার। সেখানে তাঁর নাম রাখা হয় ডালিয়া রানতজাউ মাথিয়াসেন। ডেনমার্কে তাঁর বেড়ে ওঠা, প্রতিষ্ঠা, ঘরসংসার। ২৫ বছরের চেষ্টায় সেখানে গড়ে তুলেছেন একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। ডালিয়ার চার মেয়ে, ওদের বয়স ১৭ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে।

কিন্তু নিজের প্রকৃত পরিচয় কে না জানতে চায়! ডালিয়া সম্প্রতি ডেনমার্কে নিজের ডিএনএ পরীক্ষা করান। উদ্দেশ্য বাংলাদেশে তাঁর স্বজনদের খুঁজে পাওয়া। এদিকে লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রেজওয়ানা ইসলাম সম্পূর্ণ কৌতূহলবশত নিজের ডিএনএ পরীক্ষা করান। বাবা মো. রেজওয়ানুল ইসলামের সঙ্গে লন্ডনে থাকেন তিনি। নিজের আত্মীয়স্বজন সবাইকে জানেন, চেনেন। রেজওয়ানার উদ্দেশ্য, পৃথিবীর কোন প্রান্ত থেকে তাঁর ডিএনএটা এসেছে, তা জানা। মানে তাঁর দূরপূর্বপুরুষেরা পৃথিবীর কোন এলাকার মানুষ।

ডিএনএ হচ্ছে জেনেটিক কোডের সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি মূলত অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত ম্যাক্রোমলিকিউল। এটি রাসায়নিক তথ্যের অনুবর্তী ফিতার মতো বস্তু। মানুষের দেহকোষ বা সেলের নিউক্লিয়াসে এর অবস্থান। নিউক্লিক অ্যাসিড নামে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু দিয়ে ডিএনএ তৈরি। এসব অণু একটি সুনির্দিষ্ট ধারাক্রমে সাজানো থাকে। আর তা থেকে পূর্বপুরুষের পরিচয় মেলানো সম্ভব।

ডালিয়া ই-মেইলে জানান, নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সংগঠন শাপলা এনএল-এর মাধ্যমে তিনি নিজের ডিএনএ পরীক্ষা করান। শাপলা গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ থেকে দত্তক যাওয়া ব্যক্তিরা। হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের খুঁজে দিতে সংগঠনটি বিনা খরচে ডিএনএ পরীক্ষা করে তা ম্যাচিংয়ের ব্যবস্থা করে। আর তাতেই লন্ডনে অবস্থানরত রেজওয়ানা ইসলামের সঙ্গে ডেনমার্কের ডালিয়ার ডিএনএর মিল ধরা পড়ে।

তাঁদের ডিএনএ প্রতিবেদন বলছে, এঁরা দুজন ‘থার্ড কাজিন’। অর্থাৎ তাঁরা দুজনই কোনো ব্যক্তির পুতি (নাতি/নাতিনের সন্তান)। এ তথ্য জানার পর ডালিয়া গত জুনে লন্ডনে গিয়ে রেজওয়ানার সঙ্গে দেখাও করেছেন।

এবার তাঁরা এসেছেন ঢাকায়, একই দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার। ডালিয়া তাঁর দত্তক মাকে নিয়ে ডেনমার্ক থেকে, রেজওয়ানা লন্ডন থেকে। রেজওয়ানার মা সৈয়দা ফাহলিজা বেগম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

ডালিয়ার এসব তথ্য জানান অধ্যাপক ফাহলিজা। তিনি বলেন, ‘আমার নানাশ্বশুর এবং তাঁর স্বজনেরা মগবাজার এলাকায় বসবাস করতেন। ডালিয়ার দুর্ঘটনাও ঘটেছিল মগবাজার এলাকায়। সে ক্ষেত্রে একটা যোগসূত্র অনুমান করা যায়।’

ফাহলিজা বেগম আরও বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে ডিএনএ ম্যাচিংয়ের ফল অনুযায়ী ডালিয়ার ডিএনএর সঙ্গে রেজওয়ানার বাবার দিকের ডিএনএ মিলেছে। এরপর থেকে নিজেদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ডালিয়ার মা-বাবা, দাদা-দাদিকে খোঁজাখুঁজি করেছেন তাঁরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছু জানতে পারেননি।

এদিকে বাংলাদেশে আসা উপলক্ষে ডালিয়া হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল এবং রমনা থানা-পুলিশকে তাঁর বিষয়টি জানিয়েছেন।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর ১৯৭৬ সালের চিকিৎসা রেকর্ড খুঁজে দেখছে। আর রমনা থানা-পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, থানায় মামলার নথি সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু সাধারণ ডায়েরি (জিডি) একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর আর রাখা হয় না। তারপরও ডালিয়াকে সব রকম সহযোগিতা তাঁরা করবেন।

ডালিয়ার বয়স এখন ৪৪ বছর। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ১৯৭৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২ মার্চ তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়। তাঁর চিকিৎসা করেন ডা. এস আর ভূঁইয়া (শফিকুর রহমান ভূঁইয়া)। তবে হাসপাতালে গিয়ে এই চিকিৎসক সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে ডালিয়ার ঠাঁই হয়েছিল তেরেদেস হোমসে। প্রায় পাঁচ মাস সেখানে থাকার পর ডেনমার্কের বার্থে স্কিমেল তাঁকে দত্তক নেন ওই বছরেরই ৩০ জুলাই। ডালিয়া চলে যান ডেনমার্কে, নতুন মায়ের সঙ্গে।

রেজওয়ানার মা অধ্যাপক সৈয়দা ফাহলিজা বেগম বলেন, ‘কাউকে খুঁজে না পেলেও ডালিয়া আমাদের স্বজন। কারণ, ডিএনএর প্রতিবেদন মিথ্যা হওয়ার সুযোগ নেই।’

সূত্র: প্রথম আলো

এই বিভাগের আরও খবর