img

নারী-পুরুষের মানবিক প্রয়োজন পূরণে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সুখময় ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ইসলাম বিবাহবন্ধনের নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামের বিধান মতে, বিবাহ সম্পাদনে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সম্মতি আবশ্যক। কোনো সাবালক পুরুষ কিংবা নারীকে কোনো ব্যক্তি জোরপূর্বক বিবাহ দিতে পারবে না, এমনকি তার জন্মদাতা মা-বাবাও না। জোরপূর্বক বিবাহ দিলে বিবাহ শুদ্ধ হবে না। কোনো নাবালেগ ছেলে-মেয়েকে তার অভিভাবক জোরপূর্বক বিবাহ দিলেও বালেগ হওয়ার পর তাদের অপছন্দ হলে তারা ওই বিবাহ ভেঙে দিতে পারবে। অতএব, কোনো পুরুষ কোনো নারীকে এবং কোনো নারী কোনো পুরুষকে বিবাহের মাধ্যমে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। ইসলামী শরিয়ত তাদের ওপর কারো জবরদস্তি চাপিয়ে দেয় না। ইসলামে নারীকে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কেই সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেন কোনো নারীকে কোনো অসৎ পুরুষের খপ্পরে পড়ে অসহায় ও দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করতে না হয়।

যেহেতু পৃথিবী আবাদ ও সুখময় সমাজ বিনির্মাণেই বিবাহের বিধান, তাই অপ্রয়োজনে এ বন্ধন ছিন্ন করাকে ইসলাম খুবই অপছন্দ করেছে। বিনা প্রয়োজনে তালাক দেওয়া বা তালাক চাওয়া গুনাহর কাজ। তবে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে যদি বনিবনা না হয় এবং কোনোভাবেই তাদের মিল হওয়া সম্ভব না হয় অথবা জুলুম-নির্যাতন বা কোনো অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তাহলে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি রয়েছে। প্রয়োজনে ও যৌক্তিক কারণে স্বামী তালাক দিতে পারে, তদ্রূপ স্ত্রীও তালাক চাইতে পারে। তবে ইসলামী শরিয়ত মতে, তালাকের ক্ষমতা স্বামীর হাতে ন্যস্ত।

তালাকের ক্ষমতা স্বামীর হাতে ন্যস্ত হওয়ার কারণ

এখানে প্রশ্ন জাগে যে ইসলাম ধর্ম মতে, স্বামী নিজ ইচ্ছায় তালাক দিতে পারে; কিন্তু স্ত্রী তার ইচ্ছায় তালাক দিতে পারে না। তাই নারীদের ব্যাপারে বিষয়টিতে সংকীর্ণতা এসেছে। আসলে বিষয়টি সাধারণ ও স্থূল দৃষ্টিতে এমন মনে হলেও প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন। আমরা শুরুতেই বলে এসেছি যে কোনো অসহনীয় ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি যেন না হয়, তাই শুরু থেকেই নারী-পুরুষ উভয়কেই জীবনসঙ্গী নির্বাচনে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তবে বিবাহ হয়ে যাওয়ার পর দুটি জীবন পরস্পর একাকার হয়ে যাওয়ার কারণে একটি নিয়ম ও শৃঙ্খলার খাতিরে তালাকের অধিকার শুধু স্বামীকেই দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীর হাতে এ ক্ষমতা অর্পণ না করার যৌক্তিক ও বাস্তবিক অনেক কারণ রয়েছে, যা সামান্য চিন্তা করলে এর যৌক্তিকতা বুঝে আসে। পৃথিবীর সব ক্ষেত্রেই নিয়মের খাতিরে কোনো বিষয়ের দায়িত্ব একজনের ওপর থাকে, আর অন্যরা তার সহযোগী হয়। এতে কাউকে বঞ্চিত করা উদ্দেশ্য নয় কিংবা তার অবস্থানকে খাটো করে দেখাও উদ্দেশ্য নয়; বরং শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন বিনির্মাণই মূল উদ্দেশ্য। একটি অভিন্ন কর্মক্ষেত্রে দুজন দায়িত্বশীল সমহারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় না, নচেৎ তাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। তদ্রূপ স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের শৃঙ্খলা রক্ষায় একজন প্রধান দায়িত্বশীল হবেন এবং অপরজন তার সহযোগী হবেন। এখন আমাদের দেখতে হবে, কাকে প্রধান দায়িত্বশীল বানাব আর কাকে সহযোগী বানাব? এ ক্ষেত্রে ইসলাম নারীর স্বভাবগত চঞ্চলতা ও অধৈর্যের প্রতি খেয়াল করে এবং পুরুষের দৈহিক সক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বিবেচনা করে পুরুষের ওপর তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করেছে। তবে ইসলামে দাম্পত্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে পরামর্শ করে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।

স্ত্রীর জন্য বিবাহের আগে তালাকের অধিকার সংরক্ষণ

তথাপি ইসলামে স্ত্রীকে আরেকটি অধিকার ও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো, বিবাহের সময় যেকোনো নারীই ইচ্ছা হলে স্বামীকে এ শর্ত দিতে পারে যে আমি যদিও এখন স্বেচ্ছায় আপনার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করছি, কিন্তু পরে যেকোনো সময় কারণে-অকারণে এ সম্পর্ক ছিন্ন করার অধিকার আমাকে দিতে হবে। ওই শর্তে বিবাহ সম্পাদিত হলে পৃথিবীর সব নারীই এ অধিকার প্রয়োগ করে স্বামীর ইচ্ছাবহির্ভূত হলেও তালাক গ্রহণ করে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে। (দেখুন : সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২৬২, ফাতহুল কাদির : ৩/৪২৭)

প্রশ্ন হলো, এর পরও কি স্ত্রীর জন্য ইসলামে কোনো সংকীর্ণতা রাখা হয়েছে?

বিনিময় দিয়ে তালাক গ্রহণের অধিকার

হ্যাঁ, কেউ বলতে পারেন যে ইসলামের বিধানে অজ্ঞতা বা যেকোনো কারণে যদি স্ত্রী বিবাহের আগে স্বামীর সঙ্গে ওই শর্তচুক্তি না করে থাকে, তাহলে কি তার জন্য স্বামীর ইচ্ছার বাইরে বিবাহবিচ্ছেদের আর কোনো সুযোগ নেই? তার জন্য কি সব পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে? এর জবাব হলো, ‘না।’ স্ত্রীর জন্য তার পরও বিবাহবিচ্ছেদের পথ এভাবে খোলা আছে যে সে স্বামীকে বুঝিয়ে তালাকের ওপর রাজি করাবে অথবা কোনো বিনিময়ের মাধ্যমে তালাকের সম্মতি নেবে। অর্থাৎ সে বলবে যে হয়তো তুমি আমাকে বিবাহ করতে গিয়ে মহর, অনুষ্ঠান ও অন্য খাতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তাই তুমি এ বিবাহ ভাঙতে চাচ্ছ না, আমি প্রয়োজনে তোমাকে তোমার কিছু খরচ পুষিয়ে দেব, তবু তুমি আমাকে তালাক দিয়ে দাও। এটিকে ইসলামী পরিভাষায় ‘খোলা তালাক’ বলা হয়। (দেখুন : সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২৭৩) ‘খোলা তালাকের’ বৈধতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে আমাদের কিছু ভাই সন্দেহ পোষণ করে থাকেন, সে বিষয়েও আমরা কিঞ্চিৎ আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার

এখন যদি ‘খোলা তালাকের’ ওপরও স্বামী রাজি না হয়, তাহলে কি অন্য পথ খোলা নেই? এ প্রশ্নের জবাব হলো, বরং এ ক্ষেত্রেও স্ত্রী আদালতে মামলা করে যৌক্তিক কারণ দর্শিয়ে স্বামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিচারকের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ করাতে পারে। (শরহুস সগির, দরদির : ২/৭৪৫, কিফায়াতুল মুফতি : ৬/২৫২)

এর পরও যারা এ বিষয়ে নারীর অধিকার হরণের আপত্তি তোলেন, তারা মূলত তাদের প্রতিপালক আল্লাহর বিধান মানতেই রাজি নয়। তাই অযৌক্তিক আপত্তি তুলে হলেও তাতে সন্দেহ সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করে থাকে।

কিছু সংশয় ও তা নিরসন

কিছু অবুঝ ভাই কোরআন-হাদিস থেকে প্রমাণ করতে চান যে কোরআন-হাদিসে নারীদেরও হুবহু পুরুষের মতো তালাকের অধিকার দেওয়া হয়েছে। আসলে এটি তাদের কোরআন-হাদিসের জ্ঞানশূন্যতারই প্রমাণ বহন করে। কোরআন-হাদিসের শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন না করে ইংরেজি-বাংলা অনুবাদ পড়ে এবং মস্তিষ্কে পশ্চিমা চিন্তাধারা লালন করে যারা ইসলাম চর্চা করেন, ইসলামের বিধি-বিধান অনুধাবন তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।

সংশয় ১ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদের বলে দাও, ‘যদি তোমরা দুনিয়ার জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করো, তাহলে এসো, আমি তোমাদের ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করে দিই এবং উত্তম পন্থায় তোমাদের বিদায় করে দিই।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২৮)

এই বিভাগের আরও খবর