ব্যাংকিং খাত ম্লান খেলাপিতে: সঞ্চয় ও আমানতে সুখবর
বর্তমান সরকারের ১০ বছর মেয়াদে ব্যাংকিং খাতে সঞ্চয় বেড়েছে ৭ লাখ ৮৫ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এ সঞ্চয় আগের ৩৫ বছরের তুলনায় তিনগুণ। ঋণ বিতরণও বেড়েছে একই হারে। ১০ বছরে বাণিজ্যিক ব্যাংক বেড়েছে ১০টি। তবে ব্যাংকিং খাতের এসব অর্জন খেলাপি ঋণের কারণে অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ দশমিক ৬৭ গুণ।
তথ্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে সঞ্চয় বেড়েছে ৩১১ শতাংশ বা ৩ দশমিক ১১ গুণ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে মানুষের মোট সঞ্চয় ছিল ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুন মাসে সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরের বৃদ্ধি পেয়েছে ৩১১ শতাংশ। অন্যদিকে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৩০১ শতাংশ বা ৩ দশমিক ১ গুণ। ২০০৮ সালে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ বিতরণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। ১০ বছর পর এসে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৪৭ হাজার ১২ কোটি টাকা। এ সময়ে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা।
গত ১০ বছরে সঞ্চয়ের বৃদ্ধির হার ৩১১ শতাংশ আর ঋণ বিতরণের হার ৩০১ শতাংশ। তবে গত কয়েক মাসের ঋণ বিতরণের হার কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে সঞ্চয়ের হার কিছুটা কমেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিন যুগের বেশি সময়ে যে পরিমাণ সঞ্চয় ও ঋণ বিতরণ বেড়েছে, ২০০৮ সালের পর গত ১০ বছরে বেড়েছে তার প্রায় তিনগুণের বেশি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ তথ্যকে ‘মিস ইন্টারপ্রিটেশন’ বলে মনে করেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। খোলা কাগজকে তিনি বলেন, ২০১০ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের হার কম ছিল। ২০১১ সাল থেকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ কমার যে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হচ্ছে তা ২০১১ সালের আগের। যা বর্তমান সরকারের ১০ বছরের বলে মনে হচ্ছে। তবে যে সময়েরই এই খেলাপি ঋণ হোক না কেনো-বর্তমানে তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিককরণের ফসল এটা (খেলাপি ঋণ বাড়া)। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা রাজনৈতিক ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছে এবং সব ব্যাংকে অনুমোদন দিয়েছে তারই কুফল বিপর্যস্ত ব্যাংকিং খাত।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০০৮-২০১৮ পর্যন্ত দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে ১০টি। এ ছাড়া ব্যাংক শাখার সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ২২৮টি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ৪৭টি, ২০১৮ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৫৭টিতে। ২০০৮ সালে সারা দেশে ব্যাংকগুলোর শাখা ছিল ৬ হাজার ৮৮৬টি। আর ১০ বছর পর ব্যাংক শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ১১৪টি। এর মধ্যে শহরে ৫ হাজার ২২৪টি এবং গ্রামে ৪ হাজার ৮৯০টি। একই সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ১০ বছর সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তথ্যে দেখা যায়, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার ২৬৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ বা ২ দশমিক ৬৭ গুণ।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৮ সালের জুন প্রান্তিকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ বা ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা খেলাপি। এর মধ্যে ৪ হাজার ১৫৩ কোটি ৫৮ লাখ মন্দমানের।
খেলাপি ঋণ যে হারেই বাড়ুক তা কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে মনে করেন পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। খোলা কাগজকে তিনি বলেন, মানুষের আয় ও সঞ্চয় হারে বেড়েছে তা অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে এবং সঞ্চয়ের প্রবণতা বেড়েছে। বিনিয়োগও বাড়ছে। এগুলো ঠিক আছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংকিং খাত নাজুক অবস্থায় আছে। কিছু মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। এ ছাড়া কিছু মানুষ বিভিন্নভাবে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে গেছে। এসব ঋণখেলাপি যেইই হোক তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে। শিগগিরই ব্যাংকিং খাতের এই নাজুক অবস্থা কেটে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই প্রবীণ অর্থনীতিবিদ।