img

গত এক বছরে সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নির্বাচনের বছর হওয়ায় তাদের মন রাখতে সরকারও সুবিধা দিতে কার্পণ্য করেনি। এর মধ্যে পদোন্নতির সুবিধা যেমন রয়েছে তেমনই গৃহঋণ ও গাড়ি কেনার ঋণও রয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত এক বছরে সরকারের কাছ থেকে যেসব সুবিধা পেয়েছেন তার মধ্যে পদোন্নতি, পাঁচ শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকার গৃহঋণ, উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ৩০ লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার সুবিধাসহ পেশাগত মর্যাদার বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য।
এর বাইরেও রয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত অষ্টম পে-কমিশন টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়ার সুপারিশ। একইসঙ্গে কমিশন সরকারি চাকরিজীবীদের বর্তমান ২০টি গ্রেড থেকে কমিয়ে ১৬টি গ্রেডে আনার সুপারিশ করে। কিন্তু সচিব কমিটি পে-কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশে সংশোধন আনে। এর মধ্যে টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেওয়ার সুপারিশ বহাল রাখলেও সচিব কমিটি পে-কমিশনের ১৬টি গ্রেডের সুপারিশের পরিবর্তে ২০টি গ্রেড বহাল রাখার সুপারিশ করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকার সেটাই বহাল রাখে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, উপসচিব পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তারা গাড়ি কেনার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপসচিব এই ঋণের টাকা তুলে গাড়ি কিনেছেন। শুধু টাকাই নয়, গাড়ি কিনতে সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকার পাশাপাশি গাড়ি ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করেও পাবেন তারা। ঋণের টাকা যোগান দেবে সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন শাখা থেকে এ সংক্রান্ত ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা-২০১৭ (সংশোধিত)’ জারি করা হয়েছে।
গাড়ি কেনার সংশোধিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব, বিসিএস (ইকোনমিক) ক্যাডারের যুগ্ম প্রধান বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব (ড্রাফটিং) থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা এ সুবিধা পাবেন। তবে উল্লিখিত পদে চুক্তিতে বা প্রেষণে নিয়োজিতরা এ সুবিধা পাবেন না। গাড়ির ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে চাকরির মেয়াদ অবশ্যই এক বছর থাকতে হবে। ঋণের সব কিস্তি পরিশোধের পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা গাড়ির মালিক হবেন। সর্বোচ্চ ১২০ কিস্তিতে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে ১৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ বছরই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গৃহনির্মাণ ঋণের জন্য শতকরা ৫ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে নতুন এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুসারে, জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেডভেদে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ এবং সর্বনিম্ন ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন একজন সরকারি চাকরিজীবী। এ ঋণের মোট সুদহার ১০ শতাংশ হবে। তবে এ ১০ শতাংশ সুদের ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে এবং বাকি ৫ শতাংশ ঋণগ্রহীতা পরিশোধ করবে। ছয় মাস (ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে) থেকে এক বছরের (বাড়ি নির্মাণ) গ্রেস পিরিয়ডসহ (এই সময়ের মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না) ২০ বছর মেয়াদে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
সূত্র জানায়, সরকারের প্রায় ১২ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী গৃহনির্মাণ ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। তারা এককভাবে এ ঋণ নিতে পারবেন। নীতিমালা অনুযায়ী, জাতীয় বেতন কাঠামোর পঞ্চম গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তা, যাদের বেতন স্কেল ৪৩ হাজার বা এর বেশি তারা প্রত্যেকে ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় সদরে গৃহনির্মাণে ঋণ পাবেন ৭৫ লাখ টাকা। জেলা সদরে এর পরিমাণ হবে ৬০ লাখ টাকা এবং অন্যান্য এলাকায় ৫০ লাখ টাকা।
বেতন কাঠামোর নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেড পর্যন্ত বা যাদের মূল বেতন ২২ হাজার থেকে ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, তারা ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় সদর এলাকায় ৬৫ লাখ টাকা, জেলা সদরে ৫৫ লাখ এবং অন্যান্য এলাকায় ৪৫ লাখ টাকা ঋণ পাবেন। দশম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত যাদের মূল বেতন ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা তারা ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় সদরে ৫৫ লাখ টাকা, জেলা সদরে ৪০ লাখ টাকা এবং অন্যান্য এলাকায় ৩০ লাখ টাকা ঋণ পাবেন।
১৪তম থেকে ১৭তম গ্রেড বা নয় হাজার থেকে ১০ হাজার ২০০ টাকা বেতন স্কেলে ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় সদরে ৪০ লাখ টাকা, জেলা সদরে ৩০ লাখ টাকা এবং অন্যান্য এলাকার জন্য ২৫ লাখ টাকা ঋণ পাবেন। ১৮তম থেকে ২০তম গ্রেড বা আট হাজার ২৫০ টাকা থেকে আট হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত মূল বেতন পান এমন কর্মচারীরা ঢাকাসহ সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় সদরের জন্য গৃহনির্মাণ ঋণ পাবেন ৩০ লাখ টাকা। জেলা সদরে এটি হবে ২৫ লাখ টাকা এবং অন্যান্য এলাকার জন্য পাবেন ২০ লাখ টাকা।
সরকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাড়ি ও বাড়ির জন্য ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি আরও সুবিধা দিয়েছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চাকরিরত অবস্থায় কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারীর মৃত্যু হলে সরকারের কাছ থেকে নেওয়া গৃহনির্মাণ ও মেরামত ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। পাশাপাশি অক্ষম (মানসিক প্রতিবন্ধী বা পঙ্গু) অবস্থায় ঋণগ্রহীতা অবসরে গেলে তাকেও ঋণ ও সুদের টাকা পরিশোধ করতে হবে না। এমনকি পরিবারের কাছ থেকেও এ টাকা আদায় করা হবে না।
উল্লেখ্য, সরকারি বিধান অনুযায়ী, মৃত্যুর পর সংশ্লিষ্ট চাকরিজীবীর পেনশন বা গ্র্যাচুয়িটি থেকে ঋণ ও সুদ কেটে রাখার শর্ত রয়েছে। এ শর্তের পাশাপাশি এখন এ ঋণ মওকুফ করার বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা হলো।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর থেকেই সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের দুই মেয়াদে গত প্রায় ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি পদোন্নতি পেয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। নিচের স্তরে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে শুরু করে ওপরের স্তরে পর্যায়ক্রমে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা। এরও ওপরের স্তরে ‘বিশেষ’ সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই মুহূর্তে (২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮) সরকারের প্রশাসনে সচিব পদে ৭৮ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৬২৪ জন, যুগ্মসচিব পদে ৭৬৭ জন, উপসচিব পদে এক হাজার ৬০০ জন, সিনিয়ন সহকারী সচিব পদে এক হাজার ৪৬৩ জন ও সহকারী সচিব পদে এক হাজার ১৫৪ জন কর্মকর্তাসহ মোট ১২ লাখের বেশি কর্মচারী বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
তথ্যসূত্র: জাগোনিউজ

এই বিভাগের আরও খবর