img

বইয়ের ভারে নুয়ে পড়ছে শিশুরা। সরকারের নানা পদক্ষেপের পরেও শিশুদের ওপর বাড়তি বই চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বোর্ডের বাংলা, ইংরেজি, গণিত-এ তিনটি বিষয়ের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে ধর্ম, পরিবেশ-পরিচিতি, বিজ্ঞান, ওয়ার্ড বুক, চিত্রাঙ্কন, বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা শেখার, সাধারণ জ্ঞান, নামতা-গুণ-ভাগ-জ্যামিতি আছে এমন একটি গণিত বই, ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার, গল্প ও কবিতার এবং কম্পিউটার শিক্ষা সংক্রান্ত বই।

ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাড়াও এমন সহায়ক বই চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করলেও এর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এখানে কী ধরনের শিক্ষা দেয়া হয়, দেশে কতগুলো কিন্ডারগার্টেন আছে কিংবা এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত, কিছুই জানা নেই সরকারের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুল ভেদে এসব বইয়ের সংখ্যা ও বিষয় কম-বেশি হয়ে থাকে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, বিজ্ঞান ও ধর্ম ছয়টি সরকারি বইয়ের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে দেয়া হয় ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার, কম্পিউটার, চিত্রাঙ্কন, দ্রুত পঠন ধরনের দুই থেকে ছয়টি বই। বই ছাড়াও বাড়ির কাজ ও স্কুলের কাজের আলাদা খাতাও নিতে হয়। স্কুল থেকেই সরাসরি কোচিংয়ে যায় অনেক শিশু। ব্যাগে তুলে নিতে হয় সেসব বইও। বই, খাতা, কলম, ডায়েরি, পেনসিল বক্স, জ্যামিতি বক্সে ব্যাগ ভারি হয়ে যায়। এ ছাড়া টিফিন বক্স ও পানির বোতল তো আছেই। এ প্রসঙ্গে কিন্ডারগার্টেন পড়–য়া এক ছাত্রের মা রাজিয়া সুলতানা রুম্পা বলেন, এটা শিশুর ওপর এক ধরনের শারীরিক নির্যাতন। এর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না।

রাজধানীর ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. ফেরদৌস আহাম্মেদ বলেন, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধির সময়। এ সময়টাতে শিশুদের হাড় ও মাংসপেশি অপরিণত ও নরম থাকে। ভারি স্কুলব্যাগ নিয়ে বাচ্চাদের সিঁড়ি বেয়েও উঠতে হয়। এতে ঘাড় সামনে বা পেছনের দিকে কুঁজো হয়ে যায়। তিনি বলেন, ভারি স্কুলব্যাগ বইতে শিশুদের ঘাড়, পিঠ ও মাথাব্যথা হতে পারে। এ ছাড়া শ্বাসকষ্ট ও মেরুদণ্ড বাঁকাও হয়ে যেতে পারে। এমনকি শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

সারাদেশে ছড়ানো-ছিটানো প্রায় ৭০ হাজার বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুল রয়েছে। নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে ‘বেসরকারি প্রাথমিক (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা-২০১১’ প্রণয়ন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরবর্তী সময়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর কর্তৃপক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের আগস্টে নিবন্ধন ফি ও ভূমির পরিমাণ কমানোসহ নয়টি বিধি সংশোধন করা হয়। কিন্তু সরকারি নীতিমালা থাকার পরও নিবন্ধন ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুল। শহর কেন্দি ক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সারাদেশে দিন দিন কেজি স্কুলের প্রসার পাচ্ছে। গত এক যুগে এই স্কুলগুলোর সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। এদের মধ্যে আছে ইংরেজি ও জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী চলা স্কুল। এগুলো চলছে অনেক ক্ষেত্রেই দোকানের আদলে মালিকের ইচ্ছেমতো।

নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ইচ্ছেমতো টাকা নিচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিবিহীন এসব স্কুলের শিক্ষকদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ, নেই ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা। এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগেও মান নিয়ন্ত্রণ না থাকায় শিক্ষার মান নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। ফলে মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর মিরপুর, খিলগাঁও, লক্ষ্মীবাজার কিংবা ওয়ারি এলাকায় সারি সারি কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। কেবল খিলগাঁওয়ে এক বর্গকিলোমিটার এলাকায়ই ৪৫টির মতো কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠেছে। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এবং ওয়ারি এলাকায় ডজনখানেক কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীবাজারের নবদ্বীপ বসাক লেনের গলিতে পাঁচটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। কোন কোন এলাকায় একই বিল্ডিংয়ে রয়েছে একাধিক কিন্ডারগার্টেন স্কুল। অভিযোগ আছে, এভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে নিয়মনীতি ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডারগার্টেন বানিয়ে চলছে রমরমা শিক্ষা-বাণিজ্য।

এসব প্রতিষ্ঠানে ইচ্ছেমতো বিভিন্ন শ্রেণিতে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের নির্ধারিত তিনটির বাইরে আরো ছয় থেকে ১০টি বই দেয়া হয়। বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বোর্ডের বাংলা, ইংরেজি, গণিত-এ তিনটি বিষয়ের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে ধর্ম, পরিবেশ-পরিচিতি, বিজ্ঞান, ওয়ার্ড বুক, চিত্রাঙ্কন, বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা শেখার, সাধারণ জ্ঞান, নামতা-গুণ-ভাগ-জ্যামিতি আছে এমন একটি গণিত বই, ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার, গল্প ও কবিতার এবং কম্পিউটার শিক্ষা সংক্রান্ত বই দেয়া হয়ে থাকে। স্কুল ভেদে এসব বইয়ের সংখ্যা ও বিষয় কম-বেশি হয়ে থাকে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, বিজ্ঞান ও ধর্ম ছয়টি সরকারি বইয়ের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে দেয়া হয় ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার, কম্পিউটার, চিত্রাঙ্কন, দ্রুত পঠন ধরনের দুই থেকে ছয়টি বই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান বলেন, লেখাপড়া কোনো ব্যবসা নয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞানের ভিত্তিটাকে সুগঠিত করা। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনগুলোতে এর উল্টো হচ্ছে। অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে, বই থেকেই শিশুরা সবকিছু শিখবে। তাই যত বেশি বই দেয়া যায় তত ভালো। তিনি বলেন, শিশুরা মূলত পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ থেকেই বেশি শিখে। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলো শিশুদের ‘খেলতে খেলতে শেখা’ এ তত্ত্বে পড়ানো হয়। কিন্তু এদেশে বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের চিত্ত বিনোদনের সুযোগ নেই। খেলার মাঠও নেই।

উল্লেখ্য, সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বৈষম্যহীন ও একই মানের করার কথা বলা হয়েছে। সরকার নির্ধারিত বইয়ের বাইরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়তি বিষয় পাঠ্য করতে চাইলে তার জন্য শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের অনুমতি নেয়ার কথা বলা আছে। আর শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণয়ন করবে। বোর্ডের অনুমতি ছাড়া শিক্ষাক্রমে অতিরিক্ত কোনো বিষয় বা পাঠ্যবই অন্তর্ভুক্ত করলে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর