ইলিশের জীবনরহস্য উন্মোচন করলো বাংলাদেশ
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স জানতে পেরেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।
শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সফলতার কথা জানানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলমের নেতৃত্বে গবেষক দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন- পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মো. বজলুর রহমান মোল্লা, বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. মো. শহিদুল ইসলাম ও ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. মুহা. গোলাম কাদের খান।
গবেষণা কাজটি গবেষকদের নিজস্ব উদ্যোগ, স্বেচ্ছাশ্রম এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হয়েছে।
এ গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের মৎস্য সেক্টর পূর্ণাঙ্গ জিনোম গবেষণার যুগে প্রবেশ করলো। প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম মনে করছেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের গবেষকদের সক্ষমতা প্রমাণ হয়েছে।
এর আগে দেশি ও বিদেশি গবেষকদের সমন্বয়ে পাট ও মহিষের জীবন রহস্য উন্মোচন হয়েছে। এরপর ইলিশে এই সাফল্যকে মৎস্যখাতের জন্য যুগান্তরকারী বলে মনে করছেন গবেষকরা।
ইলিশের জিনোম বিশ্লেষণ করে গবেষকরা ৭৬ লাখ ৮০ হাজার নিউক্লিওটাইড পেয়েছেন; যা মানুষের জিনোমের প্রায় এক চতুর্থাংশ। এ ছাড়াও ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ২১ হাজার ৩২৫টি মাইক্রোস্যাটেলাইট (সিম্পল সিকোয়েন্স রিপিট সংক্ষেপে এসএসআর ) ও ১২ লাখ ৩ হাজার ৪০০টি সিঙ্গেল নিউক্লিওটাইড পলিমরফিজম (এসএনপি) পাওয়া গেছে।
বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ইলিশ জিনোমে মোট জিনের সংখ্যা জানার কাজ অব্যাহত রয়েছে।
‘জিনোম’ হচ্ছে কোনো জীব প্রজাতির সকল বৈশিষ্ট্যের নিয়ন্ত্রক। অন্য কথায় জিনোম হচ্ছে কোনো জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জীবের অঙ্গসংস্থান, জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ সকল জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় এর জিনোমে সংরক্ষিত নির্দেশনা দ্বারা। পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে কোনো জীবের জিনোমে সমস্ত নিউক্লিওটাইড কীভাবে বিন্যস্ত রয়েছে তা নিরূপণ করা। একটি জীবের জিনোমে সর্বমোট জিনের সংখ্যা, বৈশিষ্ট্য এবং তাদের কাজ পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যায়।
গবেষকরা জীবন রহস্য উন্মোচন করতে মেঘনা ও বঙ্গোপসাগর থেকে জীবন্ত পূর্ণবয়স্ক ইলিশ সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে উচ্চ গুণগত মানের জিনোমিক ডিএনএ প্রস্তুত করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিনোম সিকোয়েন্সিং সেন্টারে সংগৃহীত ইলিশের পৃথকভাবে প্রাথমিক ডেটা সংগ্রহ করা হয়। এরপর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সার্ভার কম্পিউটারে বিভিন্ন বায়োইনফরম্যাটিক্স প্রোগ্রাম ব্যবহার করে সংগৃহীত প্রাথমিক ডেটা থেকে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ নতুন জিনোম বিশ্লেষণ সম্পন্ন করা হয়।
ইলিশ মাছের জীবন রহস্য উন্মোচনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম বলেন, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। পৃথিবীর মোট ইলিশ উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। এ দেশের প্রায় ৪ লাখ মানুষ জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষভাবে ইলিশ আহরণের সঙ্গে জড়িত। এই জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও টেকসই আহরণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইলিশ একটি ভ্রমণশীল মাছ। এরা সারা বছর সাগরে বাস করে কিন্তু প্রজননের জন্য সাগর থেকে বিভিন্ন নদীতে চলে আসে এবং ডিম ছাড়ার পর মা ইলিশ সাগরে ফিরে যায়।
এ গবেষণা বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে ইলিশের সংখ্যা, বিভিন্ন মোহনায় প্রজননকারী ইলিশ কি ভিন্ন ভিন্ন ‘স্টক’ নাকি এরা সবগুলো একটি স্টকের অংশ, বাংলাদেশের ইলিশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের (ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য) ইলিশ থেকে জেনেটিক্যালি স্বতন্ত্র কি না ইত্যাদি বিষয়ে জানতে সহায়তা করবে।
এ ছাড়া এর মাধ্যমে বাংলাদেশি ইলিশের একটি রেফারেন্স জিনোম প্রস্তুত করা যাবে। ইলিশের জিনোমিক ডেটাবেজ স্থাপন করা যাবে; যা যাবতীয় বায়োলজিক্যাল তথ্য ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করবে। যা ইলিশের বিভিন্ন পপুলেশনের বিস্তৃতি এবং বিভিন্ন উপ-পপুলেশনের উপস্থিতি ও তাদের মধ্যে ইকোলজিক্যাল আন্তঃসংযোগের মাত্রা নির্ণয় করবে।
এদিকে ৭ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে এ বিষয়ে প্রকাশিত একটি সংবাদ সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষকরা বলেন, সেখানে তারা কী কাজ করেছেন বা কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে উল্লেখ নেই। আমরা ২০১৫ সালে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করি এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের (এনসিবিআই) তথ্যভাণ্ডারে ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে স্বীকৃতি পাই। এ ছাড়া আমরা আগেই এ তথ্যটি দুটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে উপস্থাপন করি।