img

জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঋণের বোঝা বাড়ছে। ২০০৮ সালে ১০টি বোয়িং কেনার চুক্তির পর থেকেই প্রতি বছর ঋণ করতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। চলতি বছর দুটি বোয়িং বিমান বহরে যুক্ত হলে ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচাতে ও বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা পরিশোধে সরকারের সুদৃষ্টি চায় কর্তৃপক্ষ।

বিমান বাংলাদেশ সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের চুক্তি অনুযায়ী কয়েকটি বোয়িং বিমান ইতোমধ্যে বহরে যুক্তও হয়েছে। বোয়িংগুলো কেনার অংশ হিসেবে দুই দশমিক এক বিলিয়ন ডলার বা ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ যুক্ত হয়েছে বিমানের খাতায়। আর এই বোয়িং কেনার জন্য এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়েছে বাংলাদেশ বিমানকে। তারপরও বকেয়া আছে চার হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা।

চলতি বছর আরও দুটি বোয়িং যুক্ত হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে একটি এবং নভেম্বরে আরেকটি বোয়িং যুক্ত হবে বিমানের বহরে। তবে এই দুটি বোয়িং কেনার জন্য চার হাজার কোটি টাকা ঋণ গুনতে হবে বিমান বাংলাদেশকে।

সব মিলে আগের চার হাজার ৪৩৪ কোটি এবং দুটি বোয়িং কেনার জন্য আরও চার হাজার মিলে প্রায় ৯ হাজার কোটি ঋণ দাঁড়াচ্ছে বিমানের। শুধু কী তাই, আগামী বছর বোয়িং বিমান আনতে আরও চার হাজার কোটি টাকার চিন্তা তো বিমানের মাথায় আছেই।

বিমানের একজন কর্মকর্তা জানান, বিমান কর্তৃপক্ষ যেমন তাদের ঋণের টাকা জোগাড় করতে ব্যস্ত, তেমনি ইতোমধ্যে যোগ হওয়া উড়োজাহাজের জন্য রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির (সভরেন গ্যারান্টি) বিষয় নিয়েও আছে জটিলতা।

প্রতি বছর বিমানের বহরে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন উড়োজাহাজ, তেমনি নতুন বিমান কিনতে ঋণের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। কখনো দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক, আবার কখনো বিদেশি ব্যাংকের কাছে ছুটতে হয়েছে।

২০০৮ সালের চুক্তি অনুযায়ী কেনা বোয়িংগুলোর ঋণের টাকা পরিশোধে কানাডার মারিয়ানা লিমিটেড নামের একটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছিল বিমান বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ঋণ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে বাধ্য হয়ে নিজের তহবিল খালি করে সেই ঋণের চার দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে।

এ ছাড়াও স্থানীয় তিনটি ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটিকে। বোয়িং কোম্পানিকে ঋণের টাকা পরিশোধে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক এবং দি সিটি ব্যাংক থেকে ৯ দশমিক ২২ মিলিয়ন ডলার, সোনালী ব্যাংক (ইউকে) থেকে ৫২ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ১০২ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার নিতে হয়েছে।

বর্তমানে চলতি বছরে দুটি বোয়িং কেনার জন্য কোম্পানিকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২৫০ বিলিয়ন ডলার। তবে এত বিপুল পরিমাণ এই ঋণের বোঝা থেকে রেহাই পেতে নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তারই অংশ হিসেবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে যে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির দরকার হয়, তার দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়েছে।

বিমান কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত যেসব বোয়িং কিনেছে, সেগুলো দূরপাল্লার হলেও তা চালানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। তবে এগুলো স্বল্প ও মাঝারি দূরত্বে চলবে। আর এতে বিপুল অর্থ দিয়ে কেনা উড়োজাহাজগুলোর আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি আছে তেলের চাপ ও দাম।

পুরনো উড়োজাহাজের অত্যধিক জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় সামলাতে কাহিল ছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিশ্ববাজারে যে হারে বিমানের তেলের খরচ বাড়ছে, তা পূরণে ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে বিমানকে। এ কারণে বিমান এ পর্যন্ত ১০৪ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে তেলের কারণে।

বিশ্বে বর্তমান বাজারের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে তেল কিনতে হচ্ছে বিমান সংস্থাকে, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। অথচ অন্য দেশগুলো বিমান সংস্থাগুলোকে তেলে ভর্তুকি এবং তেল কেনার জন্য বিশেষ ছাড় বা সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তা করছে না। উল্টো এই তেল কিনতে প্রতি বছর বিমান বাংলাদেশকে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে। আর এসব কারণেও ঋণের পরিমাণ বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে অাবার গেল কয়েক মাস অাগে বিমানের যাত্রী বহনের জন্য পাঁচটি কো-বাস কিনেছে বিমান বাংলাদেশ। কিন্তু সে বাসে কর আরোপ বিপাকে পড়েছে বিমান। তবে বিষয়টি নিয়ে দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমান ও এনবিআরের মধ্যে ঝামেলাও চলছে। এ ঝামেলা মেটাতে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বিমানের পক্ষ থেকে। সমাধানও হবে বলে আশা করছেন বিমান সংশ্লিষ্টরা।

বিমান সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে তিনটি ডিসি-১০ এয়ারক্রাফট কেনা হয়েছিল। তার জন্য রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিতে ঋণ নেওয়া হয়। তখন থেকেই বিদেশি ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা শুরু হয় বিমানের। সে সময় আটটি বিদেশি ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংক (ইউকে) শাখা ঋণের টাকা নেওয়া হয়েছিল। আর তা পরিশোধ করতে বিমানের সময় লেগেছিল ১৯৮৭ সালের জুলাই পর্যন্ত।

একই বছরের আগস্ট থেকে ওই বকেয়া পরিশোধ করতে পারেনি সংস্থাটি। পরে বকেয়া ২২১ কোটি ৬৫ লাখ ৩০ হাজার ৫৬৪ টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। পরে ব্যর্থ হয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ সরকারের ইকুইটি খাতে রূপান্তরের জন্য অনুরোধ করলে এখনো তার সুরাহা হয়নি বলে জানা গেছে।

বিমান বাংলাদেশ সূত্রে জানায়, বিমানের বর্তমানে ৬৫ শতাংশ অায় অাসছে অান্তর্জাতিক রুটের টিকেট বিক্রি করে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশ অাসে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, হজ ফ্লাইট থেকে ১৫ শতাংশ এবং ডোমেস্টিক থেকে ২.০ শতাংশ অায় করে থাকে বিমান। এ ছাড়া পোলট্রি, প্রশিক্ষণ ও ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে বাংলাদেশ বিমান ২.০ শতাংশ টাকা অায় করছে।

বাংলাদেশ সরকার ২০০৭ সালে বিমান বাংলাদেশকে একটি লিমিটেডে রূপান্তরিত করে। সেই সময় থেকে এ পর্যন্ত বিমানের জেলার ছয়টি অফিস ও ছয়টি এয়ারক্রাফট মিলে বিমানের দুই হাজার কোটি টাকার মূলধন রয়েছে। প্রতি বছর এ মূলধনের পরিমাণ বাড়ছে।

জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) শাকিল মেরাজ বলেন, ‘আমাদের ঋণের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। আর চারটি বোয়িং উড়োজাহাজ যুক্ত হলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকায়। তবে আমাদের মূলধনের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সরকারের সহায়তা দরকার। সরকার চাইলে বিমানের বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে পারে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর