img

ডিসেম্বরের শুরুতে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৪৮ বছর বয়সি টিপু সুলতান। তিনি বিএনপির একজন তৃণমূল কর্মী। তার হাতে ছিল একটি প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা ছিল, ‘আমি বেগম খালেদা জিয়াকে আমার কিডনি দিতে চাই’। সেই ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। খালেদা জিয়া তখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তিনি ২৩ নভেম্বর ভর্তি হন। সারা দেশ তখন উদ্বিগ্ন ছিল। টিপু সুলতান হাসপাতালের গেটের সামনে ফুটপাতে দিন কাটাতে থাকেন। তিনি বলেছিলেন, সুস্থ হওয়ার খবর না পাওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকবেন।

টিপু সুলতান আল জাজিরাকে বলেন, ‘তিনি আমার মায়ের মতো। তিনি গণতন্ত্রের জন্য সব কিছু ত্যাগ করেছেন’। তিনি আরও বলেন, ‘আমার একটাই দোয়া, আল্লাহ যেন তাকে আসন্ন নির্বাচনটা দেখে যাওয়ার সুযোগ দেন’। তিনি ফেব্রুয়ারি ১২ তারিখের জাতীয় নির্বাচনের কথা বলছিলেন।

কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি। ৩০ ডিসেম্বর ভোরে খালেদা জিয়া হাসপাতালে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। বিএনপি বিষয়টি নিশ্চিত করে। দলটি ফেসবুকে এক বিবৃতিতে জানায়, ‘আমাদের প্রিয় জাতীয় নেতা আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি আজ ভোর ৬টায় আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন’।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির এক দীর্ঘ অধ্যায় শেষ হলো। তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে পলাতক। তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই দুই নেত্রী দেশের রাজনীতিতে আধিপত্য করেছেন। তারা পরিচিত ছিলেন ‘ব্যাটলিং বেগমস’ নামে। এই উপাধি সাধারণত ক্ষমতাশালী মুসলিম নারীদের জন্য ব্যবহার করা হয়।

খালেদা জিয়ার এক বর্ণাঢ্য ইতিহাসই রেখে গেছেন। তিনি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়েছেন। সমর্থকেরা বলেন, তিনি কখনো সমালোচকদের ওপর গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হননি। 

বিরোধী দলে থাকার সময় তিনি কঠোর আন্দোলনের পথে গেছেন। তিনি নির্বাচন বর্জন করেছেন। দীর্ঘ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ক্ষমতায় থাকার সময় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এতে তার সমর্থকদের মধ্যে গভীর আনুগত্য তৈরি হয়েছে। 

বেগম খালেদা জিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট। জন্মস্থান দিনাজপুর। তখন এটি ছিল ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গ। তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ফেনীর মানুষ ছিলেন। তিনি একসময় জলপাইগুড়িতে চায়ের ব্যবসা করতেন। দেশভাগের পর পরিবার নিয়ে তিনি পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। খালেদা জিয়া দিনাজপুরে বড় হন। তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন।

রাজনীতিতে তার প্রবেশ ছিল হঠাৎ ঘটনার ফল। তার স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। দেশ তখন গভীর অনিশ্চয়তায় পড়ে। বিএনপি হঠাৎ করেই প্রতিষ্ঠাতাকে হারায়। খালেদা জিয়া তখন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতারা তাকে সামনে আনেন। তারা তখন মনে করেন, তিনিই দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবেন। তিনি সেটার প্রমাণ ৪ দশক ধরে দিয়েছেন।

১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। সামরিক আইন জারি হয়। সেই সময় খালেদা জিয়া রাজনীতিতে উঠে আসেন। তিনি ১৯৮২ সালে বিএনপির সাধারণ সদস্য হন। ১৯৮৩ সালে ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৪ সালে তিনি দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এরপর তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হন। তার আগে দীর্ঘ বিপ্লব করে যেতে হয়েছে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। মাঝে নির্বাচনও হয়েছে, অন্য সব দল তাতে আপস করলেও খালেদা জিয়া তার অবস্থান বদলাননি, স্বৈরশাসনের সঙ্গে আপস করেননি।

ব্যক্তিগত জীবনে খালেদা জিয়া অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তার বড় ছেলে তারেক রহমান ২০০৮ সালে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। নিজেও পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার রোষানলে পড়েছিলেন। তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ২০১৫ সালে বিদেশে মারা যান। ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া কারাবন্দি হন। এরপর দীর্ঘ সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘তার পুরো জীবন ছিল কষ্টে ভরা। তবু তিনি নিজের আরামের চেয়ে দেশকে বেছে নিয়েছেন’। তিনি আরও বলেন, ‘এই কারণেই তিনি রাজনৈতিক বিভাজনের বাইরে গিয়েও তার সময়ের অন্যতম প্রতীকী নেতা হিসেবে স্মরণীয়’।

১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের পতনের পর নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া হন দেশের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী। তার শাসনামলে অর্থনৈতিক সংস্কার হয়। তৈরি পোশাক খাত বাড়ে। মেয়েদের শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। সংবাদমাধ্যম তুলনামূলক স্বাধীনতা পায়। ২০০৬ সালে তার শেষ মেয়াদ শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক তখন বাংলাদেশকে ‘এশিয়ার রাইজিং টাইগার অর্থনীতি’ বলে উল্লেখ করে। তবে তার শাসনামলের কিছু সমালোচনাও ছিল।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তিনি ও শেখ হাসিনা দুজনই কোণঠাসা হন। ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সঠিক বা ভুল, তিনি নিজের অবস্থান থেকে খুব কমই সরে এসেছেন।’ খালেদা জিয়া ছিলেন দৃঢ়চেতা। তিনি দেশ ছাড়েননি। সমালোচনার জবাবেও সংযত ভাষা ব্যবহার করেছেন। শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি প্রতিশোধ না নিতে সমর্থকদের আহ্বান জানান। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তিনি উত্তেজক ভাষা এড়িয়ে গেছেন, এমন সময়েও যখন পরিস্থিতি তার পক্ষে ছিল’।

এই বিভাগের আরও খবর