img

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার ভিত্তি হলো ইলম (সঠিক জ্ঞান) এবং আমল (সে জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ)। ইলম ছাড়া আমল অন্ধ অনুসরণে পরিণত হয়, আর আমল ছাড়া ইলম হয়ে যায় নিষ্ফল ও দায়বদ্ধতার কারণ। আল্লাহ কুরআনে এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে বারবার ইলম অর্জন ও সেই অনুযায়ী আমল করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। একজন মুমিনের ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক আচরণ ও আখিরাতের সফলতা— সবকিছুর মূলে রয়েছে ইলম ও আমলের সমন্বয়।

ইসলামে ইলমের গুরুত্ব (কুরআনের আলোকে)

১. প্রথম ওহি এবং ইলমের সূচনা

ইলম অর্জনের আহ্বান নিয়ে ইসলামের সূচনা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম নবীকে (সা.) ইলম অর্জনে পড়ার এবং শেখার নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে—

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ۝ خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ ۝ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ ۝ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ ۝ عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

‘পড়ো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। পড়ো, আর তোমার প্রতিপালক অতি সম্মানিত, যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।’ (সুরা আল-আলাক: আয়াত ১–৫)

২ ইলম ও অজ্ঞতার পার্থক্য

ইলমধারী আর অজ্ঞ ব্যক্তি কখনোই সমান নয়। কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ বিষয়টি এভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছেন—

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না—তারা কি সমান হতে পারে?’ (সুরা যুমার: আয়াত ৯)

৩. আল্লাহভীতি প্রকৃতপক্ষে ইলম থেকেই আসে

সঠিক ইলম মানুষকে আল্লাহভীরু বানায়। বিষয়টি সুস্পষ্ট করে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন—

إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ

‘আল্লাহকে তার বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই (যাদের ইলম আছে, তারাই) প্রকৃতভাবে ভয় করে।’ (সুরা ফাতির: আয়াত ২৮)

হাদিসে ইলমের গুরুত্ব

৪. ইলম অর্জন ফরজ

ইলম অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরজ ইবাদত। হাদিসে পাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ

‘ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’ (ইবনু মাজাহ ২২৪)

৫. ইলম অর্জনকারীর জন্য জান্নাত সহজ

সহজে জান্নাতে যাওয়া সেই ব্যক্তির দ্বারাই সম্ভব যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ

‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের জন্য কোনো পথে চলে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’ (মুসলিম ২৬৯৯)

৬. ইলম অর্জনকারীর মর্যাদা

আবেদ ব্যক্তির চেয়ে ইলম অর্জনকারীর মর্যাদা বেশি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

 فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِيْ عَلَى أَدْنَاكُمْ

‘আবেদের ওপর আলেমের ফজিলত হলো আমার (মতো একজন নবীর) ফজিলত তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির ওপর যেমন।’ (তিরমিজি ২৬৮৫, মিশকাত ২১৩)

৭. ইলম অর্জনকারীর জন্য সৃষ্টিজগৎ ক্ষমা প্রার্থনা করে

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইলম অর্জনকারীর জন্য আরও সুখবর দিচ্ছেন যে—

إِنَّ اللهَ وَمَلَائِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِيْ جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوْتَ لَيُصَلُّوْنَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ

‘আল্লাহ তাআলা, তার মালায়িকাহ্ (ফেরেশতারা) এবং আকাশমণ্ডলী ও জমিনের অধিবাসীরা, এমনকি পিঁপড়া তার গর্তে ও মাছ পর্যন্ত ইলম শিক্ষাকারীর জন্য দোয়া করে।’ (তিরমিজি ২৬৮৫, মিশকাত ২১৩)

৮. ইলমের সওয়াব মৃত্যুর পরও জারি থাকে

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মানুষ যখন মারা যায় তখন তার আমল বন্ধ (নিঃশেষ) হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব অব্যাহত থাকে। তন্মধ্যে একটি—

أوعلم ينْتَفع بِهِ

‘এমন ইলম (জ্ঞান)- যা থেকে মানুষ উপকৃত হতে থাকে।’(মুসলিম ১৬৩১, মিশকাত ২০৩)

আমলের গুরুত্ব (কুরআনের আলোকে)

৯. আমল ছাড়া ইলমের পরিণতি

আল্লাহ তাআলা বলেন—

كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ

‘তোমরা যা করো না, তা বলা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত ঘৃণিত।’ (সুরা আস-সাফ: আয়াত ৩)

এই আয়াত এমন লোকদের সম্পর্কে নাজিল হয়েছে, যারা মুখে বড় বড় কথা বলত, দ্বীনের দাবি করত, কিন্তু বাস্তবে সেই অনুযায়ী আমল (কাজ) করত না। তারা জিহাদ, ত্যাগ ও আনুগত্যের কথা বললেও কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকত। আল্লাহ তাআলা এই দ্বিচারিতাকে ‘مَقْت-মাকত’ (চরম ঘৃণা) শব্দ দিয়ে নিন্দা করেছেন, যা সাধারণ গুনাহের চেয়েও কঠিন অর্থ বহন করে।

আরবি “مَقْت” শব্দের অর্থ—

> প্রচণ্ড ঘৃণা

> তীব্র অসন্তোষ

> এমন ঘৃণা, যার সঙ্গে শাস্তির হঁশিয়ারও যুক্ত

অর্থাৎ, আমল ছাড়া কথা বলা শুধু অপছন্দনীয় নয় বরং আল্লাহর নিকট মারাত্মক ঘৃণিত অপরাধ।

১০. আমলের প্রয়োজনীয়তা

কুরআনে প্রায় সর্বত্রই ইমানের সঙ্গে আমালুস সালিহ একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন—

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا

‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের আতিথেয়তার জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফেরদাউস।’ (সুরা কাহফ: আয়াত ১০৭)

১১. আমল ছাড়া ইলম ভয়ংকর

> এটি মুনাফিকির লক্ষণ

কথা ও কাজের অসামঞ্জস্য মুনাফিকির মূল। যে ব্যক্তি জানে কিন্তু সে অনুযায়ী আমল করে না, তার মধ্যে মুনাফিকির একটি স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ

‘মুনাফিকের আলামত তিনটি: কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে এবং আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে।’ (বুখারি)

(সহিহ বুখারি)

> ইলম কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে দলিল হবে

ইলম যদি আমলে পরিণত না হয়, তবে সেই ইলমই কিয়ামতের দিন অভিযোগকারী হয়ে দাঁড়াবে। ইলম থাকার পরও আমল না করলে আর কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—

رُسُلًا مُّبَشِّرِیۡنَ وَ مُنۡذِرِیۡنَ لِئَلَّا یَكُوۡنَ لِلنَّاسِ عَلَی اللّٰهِ حُجَّۃٌۢ بَعۡدَ الرُّسُلِ

‘সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূলগণ আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোনো অভিযোগ/অজুহাত না থাকে।’ (সুরা নিসা: আয়াত ১৬৫)

পথভ্রষ্ট লোকেরা যাতে এহেন অজুহাত পেশ করতে বা বাহানার আশ্রয় নিতে না পারে, এজন্য আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট নিদর্শনসহ নবীদেরকে প্রেরণ করেছেন এবং তারা সর্বস্ব উৎসর্গ করে সত্য পথ প্রদর্শন করেছেন। অতএব, এখন আর সত্য দ্বীন ইসলাম গ্রহণ না করার ব্যাপারে কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না, কোনো বাহানারও অবকাশ নেই। আল্লাহর ওহি এমন এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ যার মোকাবিলায় অন্য কোনো প্রমাণই কার্যকর হতে পারে না।

> আমলের ব্যাপারে দাঈদের সর্তক হওয়া

যখন দ্বীনের কথা বলা মানুষ নিজেরাই আমল করে না— তখন মানুষ দ্বীন থেকে বিমুখ হয়; তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়; ইসলামের শিক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হয়; এ কারণেই আল্লাহ প্রথমে দাঈদেরকেই সতর্ক করেছেন।

> হৃদয় ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে যায়

ইলম থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত আমল না করলে— অন্তরে ভয় কমে যায়; গুনাহ সহজ মনে হয়; নসিহত আর প্রভাব ফেলে না; একে বলা হয় কাসওয়াতুল ক্বলব (হৃদয়ের কঠোরতা)।

সালাফে সালেহিনদের সতর্কতা

> হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন—  ‘ইলম মুখে নয়, ইলম হলো আমলে।’

> হজরত ইমাম আহমাদ (রহ.) বলেন— ‘আমল ছাড়া ইলম এমন বৃক্ষের মতো, যার ফল নেই।’

১২. ইলম ও আমলের পারস্পরিক সম্পর্ক

ইসলামে ইলম ও আমল একে অপরের পরিপূরক। ইলম ছাড়া আমল বিভ্রান্তিকর, আর আমল ছাড়া ইলম হুজ্জত (অভিযোগ) হয়ে দাঁড়াবে কিয়ামতের দিন। তাইতো সালাফে সালেহিনরা বলেছেন—

العِلْمُ يَهْتِفُ بِالْعَمَلِ فَإِنْ أَجَابَهُ وَإِلَّا ارْتَحَلَ

‘ইলম আমলকে ডাক দেয়; যদি আমল সাড়া দেয় তবে থাকে, নতুবা বিদায় নেয়।’

তাহলে করণীয় কী?

> অল্প ইলম হলেও তার ওপর আমল করা

> যা নিজে করি না, তা বলা থেকে বিরত থাকা

> ইলম অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করা

> দোয়া করা— আল্লাহ যেন ইলমকে আমাদের জন্য অজুহাত না বানান

১৩. উপকারহীন ইলম থেকে আশ্রয় চাওয়ার দোয়া

যে ইলম দ্বারা উপকার হওয়ার সুযোগ নেই; সে ইলম থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া জরুরি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لاَ يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَ تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لاَ يُسْتَجَابُ لَهَا

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই এমন ইলম থেকে যা উপকার করে না, এমন হৃদয় থেকে যা বিনয়ী হয় না, এমন নফস থেকে যা তৃপ্ত হয় না এবং এমন দোয়া থেকে যা কবুল হয় না।’ (মুসলিম ৬৬৫৮)

ইলম ও আমল—এই দুইয়ের সমন্বয়ই একজন মুসলমানকে আল্লাহ তার নৈকট্য দান করে। কুরআন ও হাদিস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে ইলম অর্জন ফরজ এবং সে ইলম অনুযায়ী আমল করা অপরিহার্য। যে ব্যক্তি ইলম শিখে আমল করে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল। আর যে ব্যক্তি ইলম শিখে আমল করে না, তার জন্য সেই ইলমই কেয়ামতের দিন সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সহিহ ইলম অর্জন এবং খাঁটি নিয়তে সে অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এই বিভাগের আরও খবর