বিয়ের পর মানুষ বদলে যায়, কথাটা কতটা যৌক্তিক?
বিয়ে হওয়ার আগে যে মানুষটি হাসিখুশি ও আনন্দময় ছিল, বিয়ের পর অনেকেই চুপচাপ বা বদলানো মনে হয়—এটি আমরা প্রায়ই শুনি। কেউ মনে করেন, দায়িত্ব মানুষকে বদলে দেয়, কেউ বলেন ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলে মানুষ বদলায়, আবার কেউ বলেন, “বিয়ের পর সবাই বদলে যায়।” কিন্তু সত্যিই কি বিয়ে মানুষকে বদলে দেয়, নাকি বিয়ের পর জীবনের চাপ আমাদের প্রকৃত স্বভাবই সামনে নিয়ে আসে?
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, মানুষের ব্যক্তিত্ব পুরোপুরি স্থির নয়। শৈশব, জিন ও পরিবেশের মিশ্রণে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। যদিও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর এটি বেশ স্থায়ী হয়, তবুও বড় জীবনের ঘটনা যেমন বিয়ে মানুষের আচরণ ও মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে পারে।
বিয়ে এমন এক সম্পর্ক, যেখানে দুইজন মানুষ প্রতিদিন একে অপরের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। নিজের সময়, অভ্যাস ও চাহিদা অন্য একজনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয়। এই নিয়মিত সমঝোতা, দায়িত্ব ও প্রত্যাশা ব্যক্তিত্বে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার মনোবিজ্ঞানী জাস্টিন ল্যাভনার ও সহকর্মীরা এই বিষয়টি গবেষণা করেছেন। তারা ১৬৯ দম্পতিকে বিয়ে হওয়ার ৬, ১২ ও ১৮ মাস পর পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং দাম্পত্য সন্তুষ্টি ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন মাপেছেন।
গবেষণায় মনোবিজ্ঞানের ‘বিগ ফাইভ’ তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়, যা ব্যক্তিত্বকে পাঁচটি মূল বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে—নতুন অভিজ্ঞতার প্রতি আগ্রহ, দায়িত্ববোধ, সামাজিকতা, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং আবেগগত স্থিরতা।
ফলাফল দেখায়, বিয়ের পর অনেক নারীর মধ্যে নতুন কিছু করার আগ্রহ কমে আসে। এটি মূলত নিয়মিত সংসারজীবনের রুটিনের কারণে। অন্যদিকে, পুরুষদের দায়িত্ববোধ বেড়ে যায়। সময়মতো কাজ করা, অর্থব্যবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তারা আগের চেয়ে বেশি সচেতন হয়ে ওঠেন।
সামাজিকতা ক্ষেত্রেও পরিবর্তন দেখা যায়। বিয়ের পর অনেক পুরুষ কম মিশুক হয়ে পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে যান। মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কিছুটা কমে যায়, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে, যা নেতিবাচক নয়—বরং আত্মবিশ্বাস ও মত প্রকাশে সহায়ক।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় আবেগগত স্থিরতায়। নারীরা বিয়ের পর মানসিকভাবে আরও স্থিতিশীল হয়ে ওঠেন, নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের অনুভূতি তাদের উদ্বেগ কমায়। পুরুষদের ক্ষেত্রেও সামান্য উন্নতি দেখা যায়।
যদিও সময়ের সঙ্গে দাম্পত্য সন্তুষ্টি কিছুটা কমে আসে—প্রধানত ‘হানিমুন পর্ব’ শেষ হওয়ার কারণে—তবে সব দম্পতির ক্ষেত্রে তা সমান নয়। যারা নতুনত্বে আগ্রহী এবং আবেগগতভাবে স্থিতিশীল, তাদের সন্তুষ্টি তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।
গবেষণায় দেখা যায়, বয়স, চাকরি বা সন্তান জন্ম দেওয়াই এই পরিবর্তনের মূল কারণ নয়। বরং দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ধারাবাহিক চাপই ব্যক্তিত্বে পরিবর্তনের প্রধান ভূমিকা রাখে।
শেষমেষ, বলা যায় বিয়ে মানুষকে বদলায়, কিন্তু এটি খারাপ পরিবর্তন নয়। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ শিখে যায় সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা এবং ভালোবাসা মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতার সঙ্গে যুক্ত। যে দম্পতিরা একে অপরের পরিবর্তন বুঝতে ও গ্রহণ করতে পারেন, তাদের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ হয়।

