ত্রিমুখী সংকটে জর্জরিত ব্রিটেন, কী করবেন স্টারমার?
৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় দেউলিয়া হওয়ার সতর্কবার্তা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিরক্ষা তহবিলে যোগদানের জন্য আলোচনা ব্যর্থ হওয়া এবং একটি নতুন বামপন্থি দলের জন্ম- মূলত এই তিন কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ দিন পার করছে ব্রিটেন।
গত সপ্তাহে ব্রিটেনের ঘটনাবলী এমন একটি চিত্র তুলে ধরে যা দেশটিকে অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে গভীর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। অভূতপূর্ব আর্থিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ইউরোপের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্কে বাধার সম্মুখীন বিদেশী সম্পর্ক এবং বিপ্লবী স্লোগানসহ দেশীয় রাজনৈতিক দৃশ্য একটি নতুন শক্তির উত্থানের সাক্ষ্য বহন করে।
আপাতদৃষ্টিতে এই তিনটি পৃথক ঘটনা প্রমাণ করে জটিল পথ বেছে নিয়েছে লন্ডন।
সম্প্রতি ইউকে অফিস ফর স্টুডেন্টসের (ওএফএস) সরকারি সতর্কতা দেশটির উচ্চশিক্ষা খাতের জন্য শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন মতে, আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যার মধ্যে ২৪টি সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকাবদ্ধ।
ওএফএসের প্রধান নির্বাহী যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স শিক্ষা কমিটিকে পরিস্থিতি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপের ৭টি-সহ প্রায় ২০টি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় গুরুতর আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন।
আর এ আর্থিক সংকটের মূল কারণ হিসেবে বছরের পর বছর ধরে 'ফি জমে যাওয়া' এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা তীব্র হারে কমে যাওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে তাদের খরচ মেটাতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চ ফি'র ওপর নির্ভর করেছে এবং এখন বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এ নিয়ে অফিস ফর স্টুডেন্টস সতর্ক করে বলেছে, শতকরা ৪৫ ভাগ প্রতিষ্ঠান এ বছর বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করে, কম পারফর্মিং কোর্স (এমনকি নটিংহ্যামের মতো শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও) কেটে ফেলে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
জবাবে যুক্তরাজ্যের শিক্ষা বিভাগ টিউশন ফি'র ওপর সীমা নির্ধারণসহ সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এদিকে, ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে কিয়ের স্টারমার সরকারের প্রচেষ্টা নিরাপত্তা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ব্রিটেনকে ইইউর এসএএফই নামে পরিচিত ১৫০ বিলিয়ন ইউরোর প্রতিরক্ষা তহবিলে যোগদানের অনুমতি দেওয়ার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। হুমকির বিরুদ্ধে ইউরোপকে সশস্ত্র করার পরিকল্পনার অংশ এই তহবিল।
আলোচনার ব্যর্থতা মূলত প্রবেশ ফি নিয়ে বিরোধের কারণে। ইউরোপীয় কর্মকর্তারা ৬ বিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যেখানে লন্ডন অনেক কম অর্থ দিতে ইচ্ছুক ছিল।
ইইউ সেক্রেটারি অব স্টেট নিক থমাস-সাইমন্ডস এই ফলাফলকে ‘হতাশাজনক’ বলে অভিহিত করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা শিল্প এখনো ‘তৃতীয় দেশ’ শর্তে প্রকল্পগুলোতে অবদান রাখতে পারে। এই পরাজয় ব্রাসেলসের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘নতুন যুগের’ সূচনা করার লেবার সরকারের দাবির ওপর একটি আঘাত এবং ব্রেক্সিট কৌশলগত সহযোগিতার ওপর ভারী ছায়া ফেলার প্রমাণ।
এমন দৃশ্যপটে ব্রিটেনে প্রাক্তন লেবার নেতা জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে ‘ইওর পার্টি’ নামে একটি নতুন দলের জন্ম হয়েছে। দলটি ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির বামপন্থি বিকল্প হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে এবং শুরু থেকেই এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
করবিন ঐতিহ্যবাহী বামপন্থিদের ওপর ভিত্তি করে আরও একটি প্রচলিত দল চান। তবে সহ-প্রতিষ্ঠাতা জাহরা সুলতানা একটি উগ্র ইহুদিবিরোধী লাইন, ন্যাটো থেকে প্রত্যাহার এবং এমনকি রাজতন্ত্রের বিলুপ্তির ওপর জোর দেন।
দলটির ৫৫ হাজার সদস্য রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় ১৯৪০ সাল থেকে এই দলটি ব্রিটেনের বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক দলে পরিণত হয়েছে। ডানপন্থি মিডিয়া এটিকে ‘অপ্রাসঙ্গিকতার পথে একটি আন্দোলন’ হিসেবে উপহাস করেছে। দলের জন্ম বামপন্থিদের মধ্যে বিভক্তি এবং স্টারমারের নীতির প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে, রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়তে পারে।
ভবিষ্যতের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা
এই তিনটি ঘটনা আজ ব্রিটেনকে এক জটিল মোড়ে ফেলে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংকট দেশে শিক্ষা এবং গবেষণার মানের ভবিষ্যত নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে। ইউরোপীয় আলোচনার ব্যর্থতা ব্রেক্সিট-পরবর্তী সহযোগিতার ব্যবহারিক সীমা উন্মোচিত করে এবং একটি নতুন বামপন্থি দলের উত্থান সমাজের রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দেয়।
এই তিন চ্যালেঞ্জের প্রতি স্টারমার সরকারের প্রতিক্রিয়া দেশের ভবিষ্যত রূপরেখা তৈরি করবে।

