১০ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা ‘আত্মসাৎ’, এস আলমসহ ৬৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
ইসলামী ব্যাংক থেকে ১০ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে চট্টগ্রামের আলোচিত শিল্পোদ্যোক্তা সাইফুল আলমসহ (এস আলম) ৬৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
রোববার দুদকের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান সংস্থার ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়– ১ এ মামলাটি করেন বলে জানিয়েছেন সংস্থার সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) তানজির আহমেদ। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, এটিই দুদকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অংকের অর্থ আত্মসাতের মামলা।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি, নীতিমালা ও পরিপত্র উপেক্ষা করে আসামিরা যোগসাজশ করে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এস আলম স্টিলস লিমিটেড ও এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের নামে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে আত্মসাৎ করেন। এর বিপরীতে রাখা হয় অপ্রতুল জামানত।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম ঘটে। ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ঋণসীমা ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা থেকে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় উন্নীত করে, যা ব্যাংকের মূলধনের ৩৫ শতাংশ অতিক্রম করে।
এটি ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধি ও নীতি বিভাগের একক গ্রাহক ঋণসীমা নীতিমালার লঙ্ঘন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সিআইবি রিপোর্টে ঋণগ্রহীতা কোম্পানির দায় অতিরিক্ত থাকলেও এবং আইসিআরআরএস (অভ্যন্তরীণ ঋণ ঝুঁকি মূল্যায়ন ব্যবস্থা) স্কোর ৫০ শতাংশের নিচে থাকার পরও ঋণ বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার লঙ্ঘন। ব্যবসায়িক আয় সন্তোষজনক না থাকা এবং জামানতের অনুপাত মাত্র ৪০–৭০ শতাংশ হওয়ার পরও ঋণ নবায়ন ও বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে ব্যাংক ও আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিতে পড়ে।
দুদক জানায়, চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রশাসন, আইটি বিভাগ ও পরিচালনা পর্ষদে আত্মীয় ও অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। সাবেক ডিএমডি তাহের আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আইসিটিডব্লিউ শাখার টর্চ সফটওয়্যার ‘ম্যানিপুলেশনের’ করে ঋণসীমা বৃদ্ধি ও মেয়াদ পরিবর্তন করা হয়, যার মাধ্যমে প্রায় ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের বরাতে দুদক জানায়, ১৩৪টি ঋণের মাধ্যমে মোট ৯ হাজার ২৮৩ দশমিক ৯৩ কোটি টাকা আহসান এন্টারপ্রাইজ, ইমপ্রেস করপোরেশন, অ্যাপারচার ট্রেডিং, ইউনিক ট্রেডার্সসহ নামমাত্র প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়, যা পরবর্তীতে এস আলম গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান—সোনালী ট্রেডার্স, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশন, এস এস পাওয়ার, এস আলম স্টিলস, এস আলম সিমেন্ট, এস আলম ভেজিটেবল অয়েল ইত্যাদি কোম্পানির হিসাবে জমা হয়।
ঋণের গতিবিধি পর্যালোচনা করে দুদক দেখেছে, ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার এস আলম ট্রেডিং কোম্পানির হিসাব থেকে ৩৭ কোটি টাকা রূপালী ব্যাংকের ওআর নিজাম রোড শাখার গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনে স্থানান্তর করা হয়। পরদিন ওই প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে ২৯০ কোটি টাকার সমপরিমাণ (২৩.৫৮ মিলিয়ন ডলার) ব্যাংক অব চায়নার সিঙ্গাপুর শাখায় এস এস পাওয়ার-১ লিমিটেডের অফশোর অ্যাকাউন্টে পাচার করা হয়।
দুদক বলছে, এ প্রক্রিয়ায় আসামিরা ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের সফটওয়্যারে কারসাজি করে আসামিরা অনুমোদনহীন ঋণ প্রদান করেন এবং মোট ৯ হাজার ২৮৩.৯৩ কোটি টাকা (বর্তমানে সুদ-আসলে পরিমাণ ১ হাজার ৪৭৯.৬২ কোটি) আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন— এস আলমের ভাই ও এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ হাসান (৪৯); এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সামাদ (৫৮) এবং একই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান গনি (৫৮); গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনের সত্ত্বাধিকারী রাশেদুল আলম (৬৪); সোনালী ট্রেডার্স লিমিটেডের সত্ত্বাধিকারী সহিদুল আলম (৬৯); এস আলম গ্রুপের পরিচালক ফারজানা পারভীন; ইমপ্রেস করপোরেশনের সত্ত্বাধিকারী মো. ইসমাইল (৬১); অ্যাপারচার ট্রেডিং হাউসের সত্ত্বাধিকারী এস এম নেছার উল্লাহ (৪০); দুলারী এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী ছাদেকুর রহমান (৫৬); আহসান এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী এহসান উদ্দীন (৩২); ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী (৫০); আনসার এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী আনছারুল আলম চৌধুরী (৬০); ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ইভিপি মিফতাহ উদ্দীন (৪৬); সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাব্বির (৫৩); ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব উল আলম (৬৯); একই ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা (৬২); সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী (৫৮); এসভিপি মোহাম্মদ ইহসানুল ইসলাম (৪৯); সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আইটি প্রধান মোহাম্মদ সিরাজুল কবির (৬২); সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আইসিটিউইং প্রধান তাহের আহমেদ চৌধুরী (৬৪); ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নাজমুল হাসান (৭৬); সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন (৫৯); সাবেক এক্সিকিউটিভ কমিটি চেয়ারম্যান ও পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিন (৬৭); সাবেক পরিচালক মো. সিরাজুল করিম (৮১); মো. জয়নাল আবেদীন (৭১); কাজী শহিদুল আলম (৭৭); সৈয়দ আবু আসাদ (৭৭); তানভীর আহমেদ (৪০); মো. কামরুল হাসান (৬৬); খুরশিদ-উল-আলম (৮৪); মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন (৫৯); মো. মোসাদ্দেক উল আলম (৬৩); মো. জাকির হোসেন (৬৩); মো. কামাল হোসেন গাজী (৬২); আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া (৬২); মো. সাইফুল ইসলাম এফসিএ (৬৫); ড. মো. ফসিউল আলম (৭৩); ড. মোহাম্মদ সালেহ জহর (৫৯); মো. সোলায়মান (৭৪); মো. কামাল উদ্দীন (৫৮); সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল হামিদ মিয়া (৭২); এসএভিপি মোহাম্মদ মোস্তাক আহমদ (৫২); সাবেক এসএভিপি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী (৫৪); এসইভিপি আহমেদ জোবায়েরুল হক (৫৩); এসভিপি এস এম তানভির হাসান (৪৮); সাবেক এভিপি হোসেন মোহাম্মদ ফয়সাল (৪৪); সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আকিজ উদ্দিন (৪৪); সাবেক এসভিপি মো. মনজুর হাসান (৫৫); সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসুজ্জামান (৬৮); সাবেক এসইভিপি মো. আবদুল জব্বার (৬৬); সাবেক ইভিপি মো. শফিকুর রহমান (৬১); সাবেক এএমডি মো. আলতাফ হোসাইন (৬২); সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী (৬৮); হাসনে আলম (৬৬); এ এ এম হাবীবুর রহমান (৬৫); সিদ্দিকুর রহমান (৫৫); বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান (৬২); এসইভিপি জি এম গিয়াস উদ্দিন কাদের (৫৪); ডিএমডি মুহাম্মদ সাঈদ উল্লাহ (৫৬); সাবেক ডিএমডি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী (৬৩); সাবেক ডিএমডি আবুল ফয়েজ মুহাম্মদ কামালউদ্দিন (৫৭); এসইভিপি মোহাম্মদ উল্লাহ (৬৩); এসইভিপি রফিকুল ইসলাম (৫৭); এসইভিপি ফরিদ উদ্দিন (৬১); জেনেসিস টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসানুল আলম (৩২) এবং একই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মায়মুনা খানম (৩৪)।

