img

জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সংকট মোকাবিলায় গঠিত সরকারের ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল’র (বিসিসিটি) ৫০ শতাংশেরও বেশি অর্থ নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষতি হয়েছে। যার আর্থিক পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। ‘বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার ধানমন্ডির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য উপস্থাপন করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। পরিস্থিতির উন্নয়নে ৯ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। 

টিআইবির গবেষণা অনুযায়ী ২০১০-২০২৪ সময়কালে বিসিসিটির অধীনে মোট ৮৯১টি প্রকল্পে প্রাক্কলিত তহবিল বরাদ্দ অনুমোদনের পরিমাণ ৪৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৩৮৯৬ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ২৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার বা ২১১০ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রকল্প অনুমোদনে ঘুস ও অবৈধ লেনদেন, ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম ও প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে টিআইবির গবেষণায়। জলবায়ু তহবিল বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপকতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সংশ্লিষ্টরা ব্যর্থ হয়েছে। একদিকে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম এবং ব্যাপক অপচয়, অন্যদিকে এসব বরাদ্দ ও প্রকল্প উপযোগী নয়। ফলে বিসিসিটিকে ঝুঁকিতে ফেলছে। এতে ভবিষ্যতে জলবায়ু খাতে অর্থ বরাদ্দ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, দুর্নীতির ফলে প্রকৃত ঝুঁকিগ্রস্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদে সরকারি বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হবে।

টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো. মাহ্ফুজুল হক ও রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মো. সহিদুল ইসলাম। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের ও গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি তহবিলের অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে ৫০ শতাংশের বেশি ক্ষতি। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির ধরন ও মাত্রা নির্দেশ করে এটি রাজনৈতিক যোগসাজশে দুর্নীতির বিশেষায়িত ক্ষেত্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এতে জড়িত বিভিন্ন অংশীজন যেমন-বিসিসিটি বোর্ড প্রধান বা সদস্যসহ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মহলের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার অপব্যবহার, বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের একাংশের দুর্নীতি ও ঠিকাদার বা বাস্তবায়নকারী সংস্থার অনিয়ম ও অবৈধ লেনদেন এ খাতে দুর্নীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অন্যদিকে জলবায়ু অর্থায়নে ঝুঁকি ও বিপদাপন্নতা বিবেচনায় প্রাধান্যনির্ভর সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা ও সুযোগ থাকলেও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তা অর্জিত হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে অর্থায়নের কথা ছিল সিংহভাগ পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলোর। যারা দায় স্বীকার করে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে স্বাভাবিক বৈদেশিক সহায়তার অতিরিক্ত ও নতুন অনুদান হিসাবে প্রদানের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই দূষণকারী দেশগুলো অঙ্গীকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক তহবিলগুলো থেকে অর্থছাড়ের পরিমাণও একেবারেই নগণ্য। ড. জামান বলেন, ‘সরকার ও বিশেষজ্ঞদের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্রকল্পে মোট বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মোট বরাদ্দ পেয়েছি মাত্র এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার। এই নগণ্য পরিমাণ অর্থও স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় না করে লোপাট করা হয়েছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় বিদেশি অর্থায়নের প্রত্যাশিত প্রবাহ না থাকায় দেশীয় অর্থায়ন এক ধরনের আশাবাদ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এ গবেষণা থেকে যা প্রকাশিত হলো তা একান্তই বিব্রতকর।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি অর্থায়ন যতটুকু ছিল তার সিংহভাগ, দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ বা অপচয় করা হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে। গত ১৬ বছরের চৌর্যতন্ত্রের সার্বিক লুটপাটের তুলনায় এই পরিমাণ কম মনে হলেও আদতে তা এ খাতের সরকারি তহবিলের ৫৪ শতাংশ। তবে এই কারণে সরকারি অর্থায়নে জলবায়ু প্রকল্পের গুরুত্বের অবমূল্যায়নের সুযোগ নেই বরং সরকারি বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের পরিচয় ও অবস্থান নির্বিশেষে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বিসিসিটিকে সরকারি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে পেশাদারত্বের সঙ্গে ভূমিকা পালনের উপযোগী করে ঢেলে সাজাতে হবে।’ গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বিসিসিটির প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে দুর্নীতির পরিমাণ সর্বোচ্চ। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে সড়কের বাতি ও সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনের আড়ালে।

এই বিভাগের আরও খবর