img

বকেয়া বিল নিয়ে আদানি গ্রুপের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। আদানি চিঠি দিয়ে সরকারকে স্পষ্ট জানিয়েছে দিয়েছে, ১০ নভেম্বরের মধ্যে আদানির বকেয়ার ৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার (প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা) পরিশোধ না করলে ১১ নভেম্বর বাংলাদেশে তাদের ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয় এ বকেয়া নিয়ে তারা আন্তর্জাতিক আদালত সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন সেন্টারে (সিআইএসি) অভিযোগ করতে একজন আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকেও (পিডিবি) একজন আইনজীবী নিয়োগ দিতে অনুরোধ করেছে আদানি। আদানি পাওয়ারে বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা এ ঘটনা স্বীকার করে বলেছেন, পিডিবিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন তারা বিষয়টি সমাধান করবে। এ ব্যাপারে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান মঙ্গলবার এ প্রতিবেদককে বলেছেন, আদানির বিষয়টির ব্যাপারে সরকার অবগত। তাদের চিঠির জবাব দেওয়া হবে। আর তারা টাকার জন্য যদি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে আমরা আমাদের মতো ব্যবস্থা নেব। তবে সরকার এ ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেবে-তা বিস্তারিত কিছু বলেননি বিদ্যুৎ উপদেষ্টা।

ভারতের ঝাড়খণ্ডে গড্ডায় আদানির ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুরোদমে উৎপাদন শুরু করে। যার পুরোটাই সরবরাহ করা হয় বাংলাদেশে। এজন্য ২৫০ কিলোমিটারের বেশি দুই দেশের মধ্যে গ্রিড লাইন বসানো হয়েছে। তবে আদানির এ কেন্দ্রে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ২০২৩ সালের প্রথমে।

চিঠিতে যা আছে : আদানি পাওয়ারের ভাইস প্রেসিডেন্ট অনিমেষ অনুরাধ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, পিডিবির সঙ্গে ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী নিয়মিত বিল পরিশোধের কথা পিডিবির। কিন্তু পিডিবির কাছে ৪৯৬ মিলিয়ন ডলার বকেয়া হয়ে আছে। যার মধ্যে কোনো রকম বিরোধ ছাড়া বকেয়া হচ্ছে ২৬২ মিলিয়ন ডলার। বকেয়াগুলোর ব্যাপারে পিডিবিকে বারবার চিঠি দেওয়া হলেও তা পরিশোধ করা হয়নি। বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি অনুযায়ী ১৩.২ সেকশনের বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী পিডিবি বকেয়াগুলো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই চুক্তির ১৩.২ ধারা অনুযায়ী পিডিবিতে এ চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এতে ১০ নভেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করতে বলা হচ্ছে। অন্যথায় ১১ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ বন্ধ থাকার সময়ে পিডিবিকে আদানির কেন্দ্রের পুরো ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ হচ্ছে প্রতি ইউনিট প্রায় ৬ টাকা।

আন্তর্জাতিক আদালত : ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছে। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বলে আসছে বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন চুক্তি এবং বিল পরিশোধ তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। এর মধ্যে কয়লার বাড়তি দাম নিয়ে আদানির সঙ্গে পিডিবির বিরোধ বাধে এবং এ পর্যন্ত ২৩৪ মিলিয়ন ডলার বিরোধ পূর্ণ বিল হিসাবে গণ্য হয়ে আছে। এ বিল নিয়ে তিন মাস আগে একেবারে সবার অগোচরে আদানির মালিক গৌতম আদানি বাংলাদেশ সফর করে বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজের সঙ্গে দেখা করে যান। সেখানে তিনি সব টাকা ছাড় করে দিতে বলেন। নতুবা বিষয়টি চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেন। জানা যায়, ওই সময়ে গৌতম আদানি সরকারের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেন। পরে তিনি চাটার্ড বিমানে ভারতে চলে যান।

সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি নিয়ে সরকার অনড় যে, বিরোধপূর্ণ বিল সরকারের কাছ থেকে আদানি কারসাজির মাধ্যমে বেশি নিয়ে যাচ্ছে। পিডিবির হিসাবে আদানি কেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দাম ধরা হচ্ছে টনপ্রতি ৬৫ ডলার। তবে আদানি বলছে ৮০ ডলার ধরে। নিয়মিতভাবেই দুই হিসাবে ১৫ থেকে ২০ ডলারের ফারাক থাকছে। এ বিরোধ নিষ্পত্তি না করেই পুরো বিল চাইছে আদানি। পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের সব কয়লার দাম প্রায় এক রকম থাকলেও আদানির কয়লার দাম তারচেয়ে অনেক বেশি। এ ব্যাপারে তাদের বারবার বলা হলেও কোনোভাবেই আদানি বিল ঠিক করছে না।

গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কোনো দরপত্র ছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইনে আদানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়। দায়মুক্তি আইন হিসাবে পরিচিত ওই বিশেষ আইন ইতোমধ্যে বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

এছাড়া বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন চুক্তি পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আদানির সঙ্গে করা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতেও বেশ কিছু অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে ওই কমিটি। তারা এটি নিয়ে এখনো কাজ করছে।

আদানির বিদ্যুৎ বন্ধ করলে কি হবে : শীতে বিদ্যুতের চাহিদা দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট কমে। তবে আদানির মতো বড় কেন্দ্র সরবরাহ বন্ধ করলে কিছুটা হলেও সমস্যার পড়বে সরকার। এখন দৈনিক ১৩ হাজার ৩০০ থেকে ১৩ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সারা দেশে উৎপাদন এবং সরবরাহ করে সরকার। এর মধ্যে আদানি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি। পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) জহুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হলে কি হবে- তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। কারণ তখন দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রাখতে হবে। এরজন্য কেন্দ্রের রসদ ফার্নেস অয়েল, কয়লা এবং গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হবে। তাহলে হয়তো শীতের সময়টা সামাল দেওয়া যাবে।

পিডিবি জানায়, বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রির কারণে বিদ্যুৎ খাতে বছরে সরকারের লোকসান ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ কারণে দারুণ আর্থিক সংকটে পিডিবি। গত দুই মাস ধরে সরকার পিডিবিকে ভর্তুকির টাকা দেওয়াও বন্ধ আছে।

পিডিবির হিসাব বিভাগের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, আদানির কেন্দ্র চালু থাকলে প্রতি মাসে বিল দিতে হয় ৮০ থেকে ৮৫ মিলিয়ন ডলার। তবে এক আদানি নয় দেশের সব বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি পিডিবির কাছে প্রচুর টাকা পাওনা আছে। এখন পর্যন্ত বেসরকারি কোম্পানিগুলোর পাওনা ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি। তিনি জানান, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার ভর্তুকির টাকা পিডিবিকে দিয়েছে কিন্তু অক্টোবর এবং চলতি নভেম্বরে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। তাই বকেয়া বিল দিন দিন বাড়ছে।

এই বিভাগের আরও খবর