সরকারি জমিতে ফের ‘ঘাঁটি’ গেড়েছে জামায়াত
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা সদরের তোহা বাজারের সরকারি জমিতে একসময় কাঠের ঘর তুলে চালানো হতো জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম। ২০০৩ সালে ওই বাজারভুক্ত সরকারি খাসজমির প্রায় ৬০ শতক জমিতে গড়ে তোলা হয় নাজিরপুর দাখিল মাদরাসা। মাদরাসার পাশেই ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদ নামে দলটির আরেকটি স্থাপনা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদরাসার নাম ব্যবহার করলেও এটি ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামীর উপজেলা কার্যালয়।
অভিযোগ ওঠার পর ইসলামী পাঠাগারের ব্যানার সরিয়ে সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় কুরআন রিসার্চ সেন্টার নামের সাইনবোর্ড। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর ওই স্থানে কোনো রাজনৈতিক বা মাদরাসার কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
সরকারি প্রকল্পের জায়গা পরিষ্কার
২০২৩ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নন-মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-এর আওতায় তোহা বাজার এলাকায় তিনটি টলসেড নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ঠিকাদার কাজ শুরু করতে গেলে উপজেলা প্রকৌশল অফিস জায়গাটি চিহ্নিত করে দেয়। সে সময় সেখানে পড়ে থাকা পুরনো কাঠের ঘর ও ভাঙাচোরা অংশ এলজিইডির শ্রমিকরা পরিষ্কার করে দেন।
ওই ঘটনার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম নূরে আলম সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মাদ্রাসা ভাঙচুরের অভিযোগ তোলা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তার নেতৃত্বে অন্তত ৭৫ জন আওয়ামী লীগকর্মী মাদরাসার কাঠামো ভেঙে ফেলে।
ওই ঘটনায় গত বছরের ২৮ অক্টোবর নাজিরপুর থানায় মামলা হয়, যা এখনো তদন্তাধীন।
নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘এলজিইডি নিজস্ব লেবার দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করেছে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের কেউ এ ঘটনায় জড়িত নয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে আমার নাম উল্লেখ করে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।’
আবারও ঘর তুলে দলীয় কার্যক্রম
স্থানীয়দের দাবি, ২০২৪ সালের শেষ দিকে জামায়াত আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে তোহা বাজার এলাকায়।
বাজারের অন্তত ১৫ শতাংশ সরকারি জমিতে নতুন করে একটি লম্বা টিনশেড ঘর তোলা হয়েছে। একই ঘরের এক প্রবেশপথে ঝুলছে দুটি সাইনবোর্ড—একটিতে নাজিরপুর দাখিল মাদরাসা, অন্যটিতে ‘ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদ’ লেখা। এই ঘরে প্রতিনিয়ত আসেন জামায়াতের স্থানীয় ও শীর্ষ নেতারা। এখানেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মসূচি। সেই কার্যক্রমের ছবি কালের কণ্ঠের কাছে রক্ষিত আছে।’
উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক মজিবুর রহমান মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০০৩ সালে সাবেক সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসার নামে সরকারিভাবে ১০ শতাংশ জমির ডিসিআর ছিল। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।’
অধ্যাপক মজিবুর আরো বলেন, গত বছরের শেষ দিকে জায়গাটিতে আবারও টিনশেড ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে মাদরাসার কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে। বর্তমানে শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কামিল পর্যায়ে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চলছে।’ যদিও মজিবুর রহমানের দাবি, মাদরাসার ১০ শতাংশ জমি সরকারের কাছ থেকে ডিসিআর নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সে দাবির পক্ষে তিনি কোনো দলিল কালের কণ্ঠকে দেখাতে পারেননি। পরে দেখাবেন বললেও আর তিনি দেখাননি।
পাঠাগারের ব্যানারে জামায়াতের জমায়েত
চলতি বছরের গত মে মাসে ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে উপজেলার ৩৫টি হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানায় বিনামূল্যে ৫০০ পবিত্র কোরআন শরীফ বিতরণ করা হয়। উপজেলা আলিয়া মাদরাসা মিলনায়তনে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি অ্যাড. আবু সাঈদ মোল্লা।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক মজিবুর রহমানসহ স্থানীয় জামায়াত-শিবির নেতারা। উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ী সমিতি ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কয়েকজন প্রতিনিধি। শুধু তাই নয় পিরোজপুর ১ আসনে জামায়াতে ইসলামীর ঘোষিত প্রাথী মাসুদ সাঈদী ওই পাঠাগারে দলীয় কর্মসূচীতে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেই ছবিও কালের কণ্ঠের কাছে রক্ষিত আছে।
প্রশাসনের নীরবতা
নাজিরপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসের একটি সূত্র জানায়, তোহা বাজারভুক্ত জায়গাটি সম্পূর্ণভাবে সরকারি খাসজমি এবং বাজারের পেরিফেরি ম্যাপের আওতাধীন। সেখানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সংগঠন গড়ে তোলার আইনি সুযোগ নেই। শুধু বাজার-সংক্রান্ত ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য চান্দিনা ভিটি বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।
অর্থাৎ, নাজিরপুর দাখিল মাদরাসা বা ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদ, উভয় প্রতিষ্ঠানেরই সেখানে অবস্থান আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৩ সালের দিকে ওই স্থানে জমি বন্দোবস্তের একটি আবেদন করা হয়েছিল, কিন্তু তা কখনো অনুমোদিত হয়নি।

