ফুঁ দিয়েই কোটিপতি, চিকিৎসা না প্রতারণা?
বছর সাতেক আগে মানুষের বাড়িতে কামলা হিসেবে খাটত, কখনো ধান কাটা কখনো গরু চড়ানো কখনো বা মাটি কাটার কাজ করত। অবসরে ধানখেতে কিংবা পাহাড়ে পুঁথি গাইত। কিন্তু ভিন্নপথ অবলম্বন করে বদলে যায় তার জীবন, কয়েক বছরের মধ্যে বনে যান কোটিপতি!
বলছিলাম চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া ইউনিয়নের কবিরাজ শাহনেওয়াজের কথা। প্রকৃত নাম আব্দুল গফুর হলেও স্থানীয়ভাবে তিনি শাহনেওয়াজ বৈদ্য নামে পরিচিত।
তার বাড়ি উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের বশির মিস্ত্রিপাড়ায়। শাহনেওয়াজের বাবা খুলু মিয়া ছিলেন একজন দিনমজুর।
এক ফুঁ দিয়েই যেকোন জঠিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা সারেন। সর্বরোগের চিকিৎসা দেন তিনি। চিকিৎসার জন্য কোনো ফি নেন না, তবে চিকিৎসা নিতে আসা সহজ-সরল রোগীদের কাছ থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। লাখ টাকায় চুক্তি করেন এমন অভিযোগও তার নামে রয়েছে!
বৈদ্যগিরি করে অর্ধকোটি টাকায় করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, রয়েছে গরুর খামার, হালচাষের ট্রাক্টর, কৃষি জমি এবং ব্যাংক ব্যালেন্স।
শনিবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শাহনেওয়াজ বৈদ্যের বাড়িতে মানুষের জটলা। বাইরে ৪-৫ জন দালাল রোগীদের সমস্যার কথা শুনে আশ্বাস দিয়ে দরকষাকষি করছেন। সবাই বৈদ্যের সামনে দাঁড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এদিকে বৈদ্য লুঙ্গী ও টি-শার্ট পরিধান করা অবস্থায় একের পর এক সিগারেট টানছেন। সিগারেট টানা শেষে কুরআন ও হাদীসের ভুলভাল আয়াত পড়ে যাচ্ছেন। তার পাশে বসে আছেন বেশ কয়েকজন অনুসারী।
এরপরই দেখা যায় সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রোগীরা, তাদেরকে ‘ফু’ দিচ্ছেন কবিরাজ। টাকা বৈদ্যের সামনে ফেলে পা ধরে সালাম করে চলে যাচ্ছেন রোগীরা।
এরপর তার অনুসারী আলম নামক আরেকজন টাকা গুলো ভাঁজ করে বান্ডিল করছেন। এভাবেই চলে চিকিৎসা।
চকরিয়া মানিকপুর থেকে আসা ববিতা বড়ুয়া নামক এক নারী জানান, দাম্পত্য কলহের সমস্যায় এ পর্যন্ত ৮ বার আসছি ২৫ হাজার টাকা ও দিয়েছি, তবুও কোনো কাজ হচ্ছেনা, স্বামী প্রবাসে থাকে এটা জেনে আরও ২৫ হাজার টাকা দাবি করছে। কী করবো বুঝে উঠতে পারছিনা।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, তার এই প্রতারণা সিন্ডিকেটের ৪/৫ জন সক্রিয় দালাল রয়েছে। এদের প্রধান হচ্ছে আলম নামক এক ব্যক্তি, যিনি সহজ-সরল মানুষদের সহজেই বশ করতে পারেন।
সপ্তাহের দুইদিন রোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে প্রতারণার আরেক ফাঁদ জিন হাজিরার হাট বসান, যেটার মাধ্যমে ব্যক্তি ভেদে ২০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেন বলে জানা গেছে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে তিনি হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিয়ে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধির আশ্রয়ে তিনি প্রতিনিয়ত এসব অপকর্ম করে যাচ্ছেন।
স্থানীয়রা আরও জানান, শাহনেওয়াজ বৈদ্য বিভিন্ন এলাকায় দালাল ঠিক করে রেখেছেন। তাদের মাধ্যমে সব রোগের চিকিৎসার প্রচার চালাচ্ছেন। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নিজেরাই তার কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলেও প্রচারণা করছেন। এসব কথা শুনে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও পার্শ্ববর্তী কক্সবাজার, বান্দরবান জেলা থেকে ও অনেক সহজ-সরল মানুষেরা ছুটে আসেন তার কাছে। তার রোগীদের বেশিরভাগই নারী এবং সুযোগ বুঝে তিনি হাতিয়ে নেন টাকা।
প্রতিবেদক পরিচয় গোপন রেখে বৈদ্যের কাছে দাম্পত্য কলহের কাল্পনিক কাহিনী সাজিয়ে বর্ণনা করে চিকিৎসা বাবদ খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ২০ হাজার টাকা দাবি করে অগ্রিম ১০ হাজার টাকা বিকাশে পাঠাতে বলে একটি বিকাশ নাম্বারও দেন।
কবিরাজের মূল দালাল আলম জানান, ৭ বছর ধরে তিনি এক অজানা শক্তির আশীর্বাদ পেয়ে বাড়িতে বসে এমন চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। ‘ফু’ দিয়ে তিনি জটিল ও কঠিন রোগ ভালো করছেন। তিনি চিকিৎসা বাবদ কোনো টাকা নেন না। তবে খুশি মনে যে যা পারেন তাই কবিরাজকে দেন। হাজার ও লাখ টাকা লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে দ্রুত চলে যান।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইল শাহনেওয়াজ বৈদ্য বলেন, বাবার দয়ায় আমি কবিরাজ হয়েছি। জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা দিচ্ছি। সবাই আমার চিকিৎসা নিয়ে ভালো হচ্ছেন। প্রতিদিন রোগীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আগে আমার কিছু ছিলনা, এখন আমার সবকিছু হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লোহাগাড়া থানার ওসি মো. আরিফুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা নেই। এ ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

