আল্লাহ যে নেতা বা শাসকের শাসনকে বরকতময় করে তোলেন

ইসলামে নেতৃত্ব একটি মহৎ দায়িত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ আমানত। একজন শাসকের সিদ্ধান্তে শুধু তার নিজের জীবন নয়, বরং পুরো জাতির কল্যাণ বা অকল্যাণ নির্ভর করে। তাই ইসলামে ন্যায়পরায়ণ শাসককে আল্লাহর ছায়াতলে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত শাসককে কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে শুধু শাসক নন, বরং তার আশেপাশের সহযোগী ও উপদেষ্টারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি হাদিসে শাসক ও প্রশাসকের সহকারীদের চরিত্রকে আল্লাহর রহমত ও গজবের সঙ্গে সম্পর্কিত করে তুলে ধরেছেন-
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِالْأَمِيرِ خَيْرًا جَعَلَ لَهُ وَزِيرَ صِدْقٍ، إِنْ نَسِيَ ذَكَّرَهُ، وَإِنْ ذَكَرَ أَعَانَهُ، وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِهِ غَيْرَ ذَلِكَ جَعَلَ لَهُ وَزِيرَ سُوءٍ، إِنْ نَسِيَ لَمْ يُذَكِّرْهُ، وَإِنْ ذَكَرَ لَمْ يُعِنْهُ
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন আল্লাহ্ তাআলা কোনো শাসনকর্তার মঙ্গল চান, তখন তাকে উত্তম সহকারী দান করেন, যাতে শাসনকর্তা আল্লাহর কোনো বিধান ভুলে গেলে সে তা স্মরণ করিয়ে দেয়, আর যদি শাসনকর্তা আল্লাহর বিধান স্মরণ করে তখন সে তা বাস্তবায়নে সহায়তা করে। পক্ষান্তরে যখন কোনো শাসনকর্তার অমঙ্গলের ইচ্ছা করেন, তখন মন্দ লোকদেরকে তার পরামর্শদাতা নিযুক্ত করা হয়; ফলে সে যখন আল্লাহর কোনো বিধান ভুলে যায় তখন তারা তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয় না। আর যদি সে শাসনকর্তা নিজেই স্মরণ করে তখন তারা তাকে তা বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করে না।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ২৯৩২; সুনানে নাসায়ি, হাদিস: ৪২০৪)
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
১. শাসকের জন্য সৎ সহচরের গুরুত্ব : ইসলামে নেতৃত্ব একটি আমানত বা বিশ্বাসভাজন দায়িত্ব।
একজন শাসক বা প্রশাসক নিজের একার চিন্তায় সঠিক পথে চলতে সবসময় সক্ষম নাও হতে পারেন। তাই তার চারপাশে কারা আছে, কে তার পরামর্শদাতা, কে তাকে ভুলে গেলে মনে করিয়ে দিচ্ছে—এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই উমর (রা.) বলতেন, ‘যে ব্যক্তি তোমার দোষ তোমাকে দেখিয়ে দেয়, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।’
২. মন্দ সহযোগীদের পরিণাম: যখন শাসকের চারপাশে দুর্নীতিবাজ, তোষামোদকারী বা দ্বীনবিমুখ লোক থাকে, তখন তারা তাকে সত্য থেকে দূরে রাখে।
এতে শুধু শাসক নয়, পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণেই ইসলামে বলা হয়েছে, ভালো শাসক পুরো জাতির জন্য রহমত, আর খারাপ শাসক পুরো জাতির জন্য আজাব।
৩. আল্লাহর মঙ্গল ও অমঙ্গল দানের পদ্ধতি: হাদিসটি ইঙ্গিত করছে—আল্লাহ যদি কারো জন্য কল্যাণ চান, তিনি তাকে এমন পরিবেশ দেন যাতে সে সহজেই ন্যায়পথে চলতে পারে। আর যদি কারো প্রতি অকল্যাণ চান, তিনি তাকে ভ্রষ্ট পরিবেশে ছেড়ে দেন। যেমন কোরআনে বলা হয়েছে: ‘যাকে আল্লাহ সৎপথে চালাতে চান, তার অন্তরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।
’ (সুরা আন‘আম, আয়াত: ১২৫)
৪. মুসলিম উম্মতের জন্য শিক্ষা: প্রশাসক বা নেতার ব্যক্তিগত যোগ্যতার পাশাপাশি, তার আশেপাশের সহযোগীদের চরিত্র ও যোগ্যতা নিয়েও সচেতন থাকা জরুরি। সাধারণ মানুষের দায়িত্ব হলো; খারাপ উপদেষ্টা ও মিথ্যাবাদীদের চাটুকারিতা থেকে শাসককে রক্ষা করা। শাসকেরও উচিত, নিজের সহচর বাছাইয়ে সতর্ক থাকা এবং তাদের দ্বীনদার ও সৎ হওয়াকে প্রধান মানদণ্ড করা।
সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা : আজকের সমাজে অনেক সময় আমরা দেখি, শাসক বা প্রশাসকের আশেপাশে তোষামোদকারী, দুর্নীতিগ্রস্ত, ব্যক্তিস্বার্থসন্ধানী উপদেষ্টা থাকে। ফলে শাসক চাইলে ন্যায়নীতি বাস্তবায়ন করতে গেলেও তাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। হাদিসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়- জাতির কল্যাণ নির্ভর করে কেবল শাসকের উপর নয়, বরং তার উপদেষ্টা ও সহযোগীদের চরিত্রের উপরও।
এই হাদীস আমাদের শেখায় যে-
* ন্যায়পরায়ণ, আল্লাহভীরু ও জ্ঞানী উপদেষ্টা একজন শাসকের জন্য আল্লাহর রহমত।
* দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভ্রষ্ট উপদেষ্টা আল্লাহর শাস্তি এবং জাতির জন্য ধ্বংসের কারণ।
* তাই নেতৃত্বে সঠিক মানুষ বাছাই করা যেমন জরুরি, তেমনি উপদেষ্টাদের দ্বীনী ও নৈতিক মানদণ্ডও নিশ্চিত করা অপরিহার্য।