তারকা আসক্তি কাটিয়ে কোচের পরিকল্পনায় বেশি মনোযোগী রিয়াল?

রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাস মানেই যেন ব্যক্তিমহিমার জয়গান। তারকাদের জৌলুশে ঢাকা পড়ে কোচদের জয়গান। তবে, সময়ের পালাবদলে আবারও সামনে আসছে কৌশলনির্ভর নতুন এক অধ্যায়। সেই পথ দেখানো নেতার নাম— জাবি আলোনসো।
রিয়াল মাদ্রিদ মানেই বড় বড় নাম। আলফ্রেদো দি স্তেফানো, ফেরেন্স পুসকাস, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো থেকে শুরু করে আজকের কিলিয়ান এমবাপ্পে বা ভিনিসিয়ুস জুনিয়র— এই ক্লাবে সব সময়ই গুরুত্ব পেয়েছে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য। ১৯৫০-এর দশকে রিয়াল মাদ্রিদ ফরোয়ার্ড সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়ের হাতে গড়া এই ধারা এখনো বিদ্যমান, যেখানে কোচের কৌশলের চেয়ে তারকার উপস্থিতিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তবে বদলে যাচ্ছে এই প্রবণতা।
কার্লো আনচেলত্তির বিদায়ের পর দায়িত্ব নিয়েছেন সাবেক মাদ্রিদ মিডফিল্ডার ও কৌশলী কোচ জাবি আলোনসো। ক্লাব বিশ্বকাপে পিএসজির বিপক্ষে সেমিফাইনালে ৪-০ গোলে হারের মধ্য দিয়েই যাত্রা শুরু হলেও আলোনসোর কৌশলগত প্রয়াস স্পষ্ট ছিল।
রিয়ালের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, যেসব কোচ সফল হয়েছেন, তারা কেউই খুব বেশি কৌশলনির্ভর ছিলেন না। জিনেদিন জিদান, আনচেলত্তি কিংবা ভিসেন্তে দেল বস্কের মতো কোচদের ক্ষেত্রেও খেলোয়াড়দের সম্পর্ক ও ড্রেসিংরুমের পরিবেশই ছিল মূল চালিকাশক্তি।
সাবেক খেলোয়াড় ও রিয়ালের এক সময়ের জেনারেল ম্যানেজার হোর্হে ভালদানো বলেন, ‘জিদান একবার বলেছিলেন— চার জনে খেলবেন, নাকি তিন জনে— তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। খেলোয়াড়দের মধ্যকার বোঝাপড়া ও ঐক্যই গুরুত্বপূর্ণ।’
এই দর্শনেই অনুপ্রাণিত হয়ে খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা দেওয়ার রীতি চালু রেখেছিলেন আনচেলত্তি। তবে এই স্বাধীনতা মাঝে মাঝে কালও হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৬ সালে প্রথমবার সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ স্বীকার করেছিলেন, ‘আমি গ্যালাকটিকোদের খারাপভাবে বড় করেছি।’
এমন অবস্থায় ২০০৬-০৭ মৌসুমে ফেরেন ফ্যাবিও কাপেলো। প্রথম থেকেই জোর দেন দলগত ভারসাম্যের ওপর, এমনকি রোনালদোকে দল থেকে বাদ দেন ইনজুরির কারণে। তার সেই সংগ্রামী দলই চার বছর পর আবার লা লিগা জয় করে। কিন্তু, ফলাফলের পরও কাপেলোকে বরখাস্ত করে ক্লাব। তখনকার ক্রীড়া পরিচালক পেদরাগ মিয়াতোভিচ বলেছিলেন, ‘আমাদের এমন কাউকে দরকার, যিনি শুধু ফল নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু দিতে পারেন।’
ঠিক এমনই চাপের মুখে আছেন আলোনসো। চার ফরোয়ার্ড— এমবাপ্পে, ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো, বেলিংহ্যাম— নিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ নয়। আলোনসো ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, সবাইকেই রক্ষণে অবদান রাখতে হবে। যদিও ক্লাব ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, তার এমন কৌশল কতদিন টিকবে, তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতি অতীতেও দেখা গেছে। ২০১২-১৩ মৌসুমে হোসে মরিনহোর সময় খেলোয়াড়দের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়ে ড্রেসিংরুম। এরপর রাফা বেনিতেজও খেলোয়াড়দের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে পারেননি। লুকা মডরিচকে ইনস্টেপে বল মারতে নিষেধ করার মতো ঘটনায় মিডিয়ায় বিদ্রুপের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
এই ব্যর্থতার পরই জিদানকে ‘কাস্তিয়া’ থেকে তুলে আনা হয় এবং শুরু হয় আরেকটি সফল যুগ।
তবে আলোনসোর কৌশল নিয়ে ইতিমধ্যে মাঠে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত মিলেছে। এমবাপ্পে ও ভিনিসিয়ুসের রক্ষণে অংশগ্রহণের চেষ্টা মার্কিন সফরে চোখে পড়েছে। আলোনসো নিজেও বলেছেন, তার দল হবে ‘উদ্দীপনাময় ও আবেগময়।’
ভালদানোর ভাষায়, ‘ফুটবল যত কৌশলনির্ভর হচ্ছে, ততই কোচরা গুরুত্ব পাচ্ছে। আলোনসোর পেছনে গার্দিওলার ছায়া রয়েছে, তার বায়ার্ন মিউনিখের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাকে এখন প্রতিপক্ষ কোচের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে এমবাপ্পে, ভিনিসিয়ুসদের মতো তারকাদের সঙ্গে।’