মুসলিমের সাফল্যের মূলমন্ত্র ঈমান-এখলাস ও সুন্নাহ

আলহামদুলিল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র সেই আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আমাদের হেদায়াত দিয়েছেন, ক্ষমার পথ খুলে দিয়েছেন এবং প্রতিনিয়ত আমাদের কল্যাণের পথনির্দেশ করেন। আমরা তাঁর কাছেই সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমাদের অন্তরের বিকার ও আমলের অনিষ্টতা থেকে আমরা তাঁর কাছেই আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না; আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন, কেউ তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে না।
আমরা সাক্ষ্য দিই যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই। আমরা আরো সাক্ষ্য দিই যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও সর্বশেষ রাসুল।
কোরআনের ভাষায় তাকওয়ার নির্দেশ
আল্লাহ তায়ালা বলেন :
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করো এবং কেউ যেন ইসলাম ব্যতীত অন্য অবস্থায় মৃত্যু না বরণ করে।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০২)
তিনি আরো বলেন :
‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের একক প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর সেখান থেকে তাঁর সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন, এবং উভয়ের মাধ্যমে অসংখ্য নারী-পুরুষ ছড়িয়ে দিয়েছেন।’
(সুরা : আন-নিসা, আয়াত : ১)
এই আয়াতসমূহে আমাদের জন্য তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বনের নির্দেশ রয়েছে; যা ঈমানের ভিত্তি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উপায়।
এখলাস ও সুন্নাহ ঈমান ও ইবাদতের ভিত্তি
খুতবায় বলা হয়, আল্লাহর প্রতি ঈমান শুধু মুখের উচ্চারণ নয়।
বরং তা অন্তরের বিশ্বাস, জিহ্বার স্বীকৃতি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কর্মে প্রকাশ পায়। একমাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত ও মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করাই ঈমানের প্রকৃত বাস্তবায়ন। এই দুটি শর্ত পূরণ না হলে কোনো আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।
রাসুল (সা.)-এর এক মহামূল্যবান নির্দেশ
একজন সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘আমাকে এমন একটি কথা বলুন, যাতে অন্য কাউকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে না হয়।’
রাসুল (সা.) বললেন:
قُلْ آمَنْتُ بِاللَّهِ، ثُمَّ اسْتَقِمْ
‘বল, আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি; তারপর তাতে অটল থাকো।’
মুসলিম, হাদিস : ৩৮)
এই সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর হাদিসে ইসলামের পূর্ণ ভিত্তি নিহিত রয়েছে—ঈমান এবং তাতে স্থিরতার ওপর।
এখলাস ছাড়া কোনো ইবাদত কবুল নয়
শুধু আমল করাই যথেষ্ট নয়, বরং তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। ইমাম ফুযাইল ইবনে আয়াজ (রহ.) বলেন :
“যদি আমল খাঁটি (ইখলাসপূর্ণ) না হয়, তা কবুল হয় না। আর যদি আমল সহীহ (সুন্নাহ অনুযায়ী) না হয়, তা-ও কবুল হয় না—যতক্ষণ না তা খাঁটি এবং সঠিক উভয়ই হয়।”
অর্থাৎ আমল হতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং তা হতে হবে নবী (সা.)-এর দেখানো পথে।
সুন্নাহ নির্ভুল অনুসরণই সাহাবিদের পথ
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, সাহারিগণ কখনো গাইরুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে) ইবাদত করতেন না। তারা ফেরেশতা, নবী, কবর কিংবা মৃত কারো কাছে সাহায্য চাইতেন না। তারা জানতেন—এ সব কিছুই শিরকের অন্তর্ভুক্ত। বরং তারা শুধু আল্লাহর দিকেই রুজু করতেন এবং তাঁরই দিনে নিজেদের উৎসর্গ করতেন।
তারা একাগ্রতার সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতে আদায় করতেন, রমজানে রোজা রাখতেন, জাকাত দিতেন, হজ করতেন এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতেন। তাদের দিন ছিল শুধু নবী (সা.)-এর আদর্শে গঠিত।
সুন্নাহ অনুযায়ী হওয়া ও খাঁটি নিয়ত আমলের শর্ত
ইবাদত বা দিনি কাজ করতে গিয়ে যদি কেউ নিজের ইচ্ছা, প্রবৃত্তি, সংস্কার বা বিদআতকে অনুসরণ করে, তবে তার সে ইবাদত গ্রহণযোগ্য নয়। বরং তা শিরকের নিকটবর্তী হয়ে পড়ে। ইসলামের ব্যাখ্যা তাই : আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ, ইবাদতের মাধ্যমে আনুগত্য, এবং শিরক থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা।
জান্নাতের সুসংবাদ তাদের জন্য যারা...
মহান আল্লাহ বলেন :
‘নিশ্চয়ই যারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ’, অতঃপর তাতে অটল থাকে, ফেরেশতারা তাদের কাছে অবতীর্ণ হয় এবং বলে—ভয় করো না, দুঃখ করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছে।’
(সুরা : ফুসসিলাত, আয়াত : ৩০)
খুতবার শেষ প্রান্তে এসে মুসলমানদের উদ্দেশে বিশেষভাবে দরুদ পাঠ করার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়। কারণ, রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করা মুমিনের ঈমানের নিদর্শন এবং এতে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত লাভ হয়।
‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর, তাঁর পরিবার ও সাহাবিগণের ওপর অগণিত রহমত বর্ষণ করুন।’
খুতবার শেষাংশে বিশ্ব মুসলিমদের, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের মজলুম ভাইদের জন্য হৃদয়বিদারক মোনাজাত করা হয়। বলা হয় :
‘হে আল্লাহ! আপনি তাদের সীমা লঙ্ঘনকারী দখলদারদের বিরুদ্ধে সাহায্য করুন। ক্ষুধার্তদের আহার দিন, উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিন এবং তাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন শক্তিশালী অভিভাবক নিয়োগ করুন। হে আল্লাহ! ইসলামকে বিজয়ী করুন, মুসলমানদের সম্মান দিন, মুমিনদের শক্তি দিন। আর শত্রুদের চূর্ণ করে দিন।’
এই খুতবা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—একটি মুসলিম জীবনের প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করে তিনটি মূলনীতির ওপর : (১) আল্লাহর প্রতি খাঁটি ঈমান ও তাকওয়া (২) শুধু তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত (ইখলাস) (৩) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহর অনুসরণ।
মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা যে তিনি আমাদের ঈমান, ইখলাস ও সুন্নাতের ওপর অটুট থেকে আমল করার তাওফিক দান করেন।
ভাষান্তর ও সংক্ষেপ :
মুফতি সাইফুল ইসলাম, প্রবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস
saifpas352@gmail.com