চীনের বিরল মাটির রাজ্য : মিলল বিষাক্ত পানি আর বিক্ষত পাহাড়

চীনের উত্তরাঞ্চলীয় ইননার মঙ্গোলিয়ার বায়ান ওবো শহরের সীমানায় দাঁড়ালে যা চোখে পড়ে তা হলো- পৃথিবীর সাদা মাটি ও ক্ষতবিক্ষত পাহাড়। যা একসময়ে সবুজ মঙ্গোলিয়ান ঘাসভূমিতে ঢেকে ছিল। এখন গভীর গর্তের মধ্য থেকে ধোঁয়া উঠছে। মূল্যবান সম্পদ খোঁজার জন্য সেখানে পৃথিবীর খোলসের একাংশ কেটে ফেলা হয়েছে।
আপনি হয়তো এই শহরের নাম না শুনে থাকতে পারেন, কিন্তু আমাদের আধুনিক জীবনের অনেক কিছু থেমে যেতে পারে বায়ান ওবো না থাকলে। বায়ান ওবো শহরের নামকরণ করা হয়েছে তার জেলার নামানুসারে। যেখানে বিশ্বের অর্ধেক পরিমাণ বিরল ধাতুর খনি রয়েছে। এই ধাতুগুলো আমাদের প্রায় সব আধুনিক যন্ত্রপাতির জন্য অপরিহার্য যেমন— স্মার্টফোন, ব্লুটুথ স্পিকার, কম্পিউটার, টিভি স্ক্রিন, এমনকি বৈদ্যুতিক যানবাহনেও।
এগুলো খনন এবং পরিশোধন করার ক্ষেত্রে চীন এগিয়ে গেছে। বিরল ধাতু খনন ও পরিশোধনে নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশটি। এই আধিপত্য চীনের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিশাল সুবিধা এনে দিয়েছে। যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে আলোচনা, কিন্তু চীন তা অর্জনের জন্য একটি বিশাল মূল্য পরিশোধ করেছে।
এই বিষয়ে আরো জানতে চীনের দুটি প্রধান বিরল ধাতু খনিকেন্দ্র- বায়ান ওবো এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় জিয়াংসির গাঞ্জৌ শহরে গিয়েছিল বিবিসি। সেখানে তারা দেখেছে, তেজস্ক্রিয় কাদায় ভরা মানবসৃষ্ট হ্রদ, দূষিত পানি ও মাটি। এর ফলে অতীতে ক্যান্সার এবং জন্মগত ত্রুটি সৃষ্টি করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেইজিং তার পরিবেশগত রেকর্ডের সমালোচনা সহ্য করতে খুবই সংবেদনশীল। তাদের পুলিশ আটক করেছে, প্রশ্ন করেছে এবং এক অজ্ঞাত খনি কর্মকর্তার সঙ্গে তিন ঘণ্টার একটি অবস্থানে আটকে রেখেছিল।
তিনি বিবিসির দলকে ভিডিও মুছে ফেলতে বলেছিলেন। সরকারের তরফ থেকে খনিশিল্পের তদারকি শক্তিশালী করতে নতুন নিয়মাবলি প্রকাশিত হয়েছে।
বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির জন্য শক্তিশালী চুম্বক তৈরিতে ব্যবহৃত নিওডিয়ামিয়াম এবং ডিসপ্রোসিয়াম নামক বিরল পদার্থের জন্য মেশিনগুলো ক্রমাগত তাদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এই বিরল ধাতুগুলো খুঁজে বের করার জন্য মেশিনগুলো মাটির ওপরের স্তর সরিয়ে দেয়। যার ফলে ক্ষতিকারক ধুলো উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে কিছুতে উচ্চ মাত্রার ভারী ধাতু এবং তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকে।
বিজ্ঞানীরা জানান, চীনের খনি কার্যক্রমের কারণে পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে, তা কমানোর জন্য কর্তৃপক্ষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু উত্তরের খনি কার্যক্রম এখনো বাড়ছে। গত কয়েক দশকের স্যাটেলাইট চিত্রগুলোতে দেখা য্য়, বায়ান ওবো খনি কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। খনিটি রাজধানী বেইজিং থেকে ৯ ঘণ্টার ড্রাইভ দূরে, অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়ার বিশাল, শুষ্ক অঞ্চলে অবস্থিত।
গাঞ্জৌ শহরে ক্ষতিকারক বর্জ্যে পূর্ণ ছোট, গোলাকার কংক্রিট পুকুরগুলো খাড়া পাহাড়ের শীর্ষে রয়েছে এবং অনেকগুলো পুকুর খোলা আকাশের নিচে। এই পুকুরগুলো ‘লিচিং পন্ড’ নামে পরিচিত। খনির মাটির সঙ্গে মিশে থাকা বিরল ধাতু আলাদা করার জন্য অ্যামোনিয়াম সালফেট এবং অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইডসহ অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়।
একসময় এখানে হাজারের বেশি অবৈধ খনি ছিল। যার মধ্যে কিছু অবৈধ ছিল। কম্পানিগুলো একটি খনি থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে অন্য খনিতে স্থানান্তরিত হতো। ২০১২ সালে চীনা সরকার খনি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয় এবং খনি লাইসেন্সের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দেয়। তবে তত দিনে এলাকার পরিবেশে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।
কয়েক দশক ধরে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বন উজাড়, মাটি ক্ষয় এবং নদী ও কৃষিজমিতে রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় কৃষক হুয়াং জিয়াওকং বলেন, এখনো অনুপযুক্ত খনির অনুশীলনের কারণে ভূমিধস হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষক হুয়াং শিয়াচং বলেন, ‘এই সমস্যা আমার পক্ষে সমাধান করা খুব কঠিন। এটা এমন কিছু, যা উচ্চ পর্যায়ের সরকারকেই সমাধান করতে হবে।’
চীনে গ্রামবাসীদের পক্ষে বিশাল কম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা বিরল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সঙ্গেও কথা বলাও কঠিন বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিন্তু কৃষক হুয়াং শুনানির জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যুরোতে মামলা করেছেন। স্যাটেলাইট ছবিতে হুয়াংয়ের গ্রাম এবং জমির চারপাশে খনির পুকুর দেখা গেছে। ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত বর্গক্ষেত্রের মধ্যে কমপক্ষে চারটি স্থান দৃশ্যমান।
বাওতো শহরের বায়ান ওবোর দক্ষিণে অবস্থিত বৃহত্তম লেজ পুকুর এবং তার আশপাশে সবচেয়ে খারাপ স্বাস্থ্যগত প্রভাবগুলো পাওয়া গেছে। অধ্যাপক ক্লিংগারের মতে, ২০১০ সালের আগের দশকগুলোতে গ্রামবাসীরা পানিতে অত্যধিক ফ্লোরাইড এবং তীব্র আর্সেনিক বিষাক্ততার কারণে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিল।
তাদের বেশির ভাগই ১৯৫০-এর দশকে খনির বর্জ্য ফেলার জন্য মানবসৃষ্ট হ্রদ, ওয়েইকুয়াং বাঁধের কাছে বসবাস করতেন। যদিও কর্তৃপক্ষ এখন থেকে গ্রামবাসীদের সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তবে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই লেজ পুকুরটি এখনো রয়ে গেছে, যা থোরিয়ামসহ ধূসর কাদা দিয়ে ভরা।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই বিষাক্ত কাদা ধীরে ধীরে ভূগর্ভস্থ জলে মিশে যেতে পারে এবং চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী, হলুদ নদীর দিকে চলে যেতে পারে। হলুদ নদী উত্তর চীনের একটি প্রধান পানীয় জল সরবরাহকারী উৎস। এর মাধ্যমে পরিবেশ এবং মানুষের স্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
বিশ্বব্যাপী পকেট গ্যাজেট, বৈদ্যুতিক যানবাহন, সৌর প্যানেল, এমআরআই মেশিন এবং জেট ইঞ্জিনের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি উদ্বেগজনক পরিসংখ্যানও সামনে এসেছে। মাত্র এক টন বিরল মাটির খনিজ খনন করা মানে প্রায় ২ হাজার টন বিষাক্ত বর্জ্য তৈরি করা।
চীন এখন তার বিরল মাটির খনন কার্যক্রমের পরিবেশগত ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে, তবে বিদেশে খনির কার্যক্রমও সম্প্রসারণ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশও তাদের নিজস্ব বিরল মাটি সন্ধানের উদ্যোগ দ্রুত শুরু করতে তৎপর। তবে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে এই ধাতুগুলো যেখানেই খনন করা হোক না কেন, সঠিক সমাধান ছাড়া প্রকৃতি এবং মানুষের জীবন বিপদে পড়বে।
তবুও বায়ান ওবোর কিছু কৃষক বিশ্বের বিরল মাটির রাজধানীতে তাদের জীবনধারা একধরনের সহনশীলতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। যে ধাতুগুলো তাদের জমি ধ্বংস করেছে এবং জলকে বিষাক্ত করেছে, সেই ধাতুগুলোই এখন তাদের জীবিকার পথ তৈরি করেছে।
একজন কৃষক বিবিসিকে জানিয়েছেন, ‘বিরল মাটির জন্য এখন টাকা আছে। খনিগুলো প্রতি মাসে ৫ হাজার বা ৬ হাজার ইউয়ান (প্রায় ৮৩৭ ডলার বা ৬১৫ পাউন্ড) দেয়।’
তিনি আরো বলেছেন, তিনি ঘোড়া পালন করে অর্থ হারিয়েছেন, যা একসময়ের ঐতিহ্যগত জীবিকা ছিল। তবে এখন খনির কাজের কারণে তার আর্থিক অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ঘোড়াগুলো এখনো খনির পাশে চারণভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং খননকারীরা আরো বিরল মাটির সন্ধানে লেগে আছে।
সূত্র : বিবিসি