img

গ্রিক সাইপ্রাসের লারনাকা ও লিমাসল অঞ্চলে ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীদের জমি ও সম্পত্তি কেনার হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এই প্রবণতা ঘিরে দেশটির অভ্যন্তরে রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে বিরোধীরা অভিযোগ করছে—ইসরায়েল দেশটিতে কার্যত ‘নতুন উপনিবেশ’ গড়ে তুলছে।

বর্তমানে গ্রিক সাইপ্রাসে প্রায় ১৫ হাজার ইসরায়েলি নাগরিক বসবাস করছেন বলে জানা গেছে। এর ফলে অঞ্চলটির জনমিতিক কাঠামো ও ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাস তুর্কি প্রজাতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে।

 

 

গ্রিক সাইপ্রাসের প্রধান বিরোধী দল একেলের নেতা স্টেফানোস স্টেফানু পরিস্থিতিকে ‘পরিকল্পিত জনবসতির কৌশল’ বলে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, দেশটি ‘হাতে থেকে ফসকে যাচ্ছে’।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও জনসম্মুখে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ‘গ্রিক সাইপ্রাস এখন যেন ইসরায়েল দখল করা নতুন দেশ।’ তিনি দাবি করেন, ‘ইসরায়েল দেশটির ভেতরে নিজস্ব বন্ধ গোষ্ঠী তৈরি করছে, যেখানে জনসংখ্যার গঠন পাল্টে ফেলা হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে।

 

এই জনবসতি সম্প্রসারণে সক্রিয় সংগঠনের মধ্যে রয়েছে চাবাদ, একটি কট্টর ধর্মীয় ইহুদি সংগঠন। তারা ইতিমধ্যে সেখানে সিনাগগ, কিন্ডারগার্টেন, কোশার খাদ্য অফিস ও কবরস্থান স্থাপন করেছে।’

 

বিশ্লেষকদের মতে, এসব অবকাঠামো কেবল পর্যটন নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক প্রভাব বিস্তার ও ভবিষ্যৎ সংকটে গুপ্তচর কার্যক্রম চালানোর সুযোগ তৈরি করছে। তুরস্কের দৈনিক মিলিয়েত-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আংকারার সোশ্যাল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এমেটে গোজুগুজেলি বলেন, ‘এটি কেবল সম্পত্তি কেনাবেচার বিষয় নয়—এটি নিরাপত্তা, গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গভীর উদ্বেগের বিষয়।

 

 

তিনি বলেন, চাবাদ ও অনুরূপ ধর্মীয় সংগঠনগুলো কেবল ধর্মীয় কাঠামোর ছায়ায় কার্যকর রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা কাজ পরিচালনা করতে পারে। এসব গোষ্ঠী পর্যবেক্ষণ, প্রচারযুদ্ধ বা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। চাবাদের প্রভাব উত্তর সাইপ্রাস পর্যন্ত পৌঁছেছে বলেও সতর্ক করেন গোজুগুজেলি। তার মতে, এই সংগঠনগুলো ‘সফট পাওয়ার টুল’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এমন একটি জনসংখ্যা তৈরি হতে পারে, যারা ইসরায়েলের নীতির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়বে। যা দ্বীপটির রাজনৈতিক ঐক্যকে দুর্বল করতে পারে।

 

 

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে কৌশলগত প্রতিযোগিতা

এই পরিস্থিতি এমন এক সময় চলছে, যখন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক জটিল সামুদ্রিক বিরোধে জড়িত। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাসের মধ্যে গঠিত এক নতুন কৌশলগত জোটকে তুরস্কের আঞ্চলিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে একটি পাল্টা ভারসাম্য রক্ষার কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এগুলো জ্বালানি অনুসন্ধান, যৌথ সামরিক মহড়া এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে গঠিত।

অনেকেই আশঙ্কা করছেন, নতুন ইসরায়েলি বসতিগুলো এই বৃহৎ জালের একটি ‘নোড’ হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশেষ করে লিমাসল ও লারনাকায় যদি সামরিক মানের নজরদারি ব্যবস্থা বসানো হয়, তাহলে তা তুরস্কের নৌ ও বিমান তৎপরতা নজরে রাখার জন্য ব্যবহার হতে পারে। গোজুগুজেলি সতর্ক করে বলেন, ইসরায়েলি অভিবাসীদের সবাইকে সাধারণ নাগরিক ভাবা ভুল হবে।
তাদের অনেকেই হতে পারে দ্বৈত-চরিত্রের ব্যক্তি—যারা উন্মুক্ত গোয়েন্দা তৎপরতা, মানচিত্রভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ বা সংকটকালে সক্রিয় সংঘবদ্ধতা পরিচালনা করতে পারে।

তার মতে, ‘এটি নিছক অভিবাসনের ঢেউ নয়।’ বরং এটি সুসংগঠিত, আদর্শিকভাবে প্রভাবিত একটি জনগোষ্ঠীর অগ্রযাত্রা—যা কেবল নিরাপত্তার নয়, দ্বীপটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে উঠছে।

জমি কেনাবেচায় প্রশ্ন উঠেছে সার্বভৌমত্ব নিয়ে

ইসরায়েলিদের বড় পরিসরে জমি কিনে নেওয়ার ঘটনায় গ্রিক সাইপ্রাসে জমির মালিকানা ও সার্বভৌমত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, ভবিষ্যতের শান্তি আলোচনায় এই ধরনের জনমিতিক ও অর্থনৈতিক উপস্থিতিকে ব্যবহার করে নতুন দাবি ও নীতি চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া গ্রিক সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক ও বসতি সংক্রান্ত চুক্তি ১৯৬০ সালের ‘ট্রিটি অফ গ্যারান্টি’ লঙ্ঘন করছে বলে মত বিশ্লেষকদের। এই চুক্তির আওতায় তুরস্ক, গ্রিস ও যুক্তরাজ্য দ্বীপটির গ্যারান্টার শক্তি হিসেবে নির্ধারিত।

এমেতে গোজুগুজেলি তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাসকে উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে নজরদারি বাড়ানো এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারের আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ড্রোনের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চালানো, বিশেষত চাবাদ গোষ্ঠীর উপস্থিতি কূটনৈতিক পর্যায়েও বিবেচনায় আনা জরুরি। 

বিশ্লেষকদের মতে, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলিদের জমি কেনা ও বসতি স্থাপন কেবল একটি জনমিতিক পরিবর্তন নয়—বরং এটি বৃহৎ কৌশলগত চাল, যার সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে তুরস্কের সামুদ্রিক সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে। এখন দেখার বিষয়—এই পরিস্থিতি কীভাবে সামলায় তুরস্ক ও তার মিত্ররা।

সূত্র : তুর্কি টুডে

এই বিভাগের আরও খবর


সর্বশেষ