img

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সব পক্ষকে আলোচনায় বসে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। অন্যদিকে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পর ভোরে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে ইরান। এতে ১১ জন আহত হয়েছে। তবে গুরুতর কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

 

পরে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী জানায়, তারা ইরানের পশ্চিমাঞ্চলে ‘সামরিক স্থাপনার’ ওপর হামলা শুরু করেছে। তারা এক্সে পোস্টে আরো বলেছে, ‘ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আঘাত করতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুত রাখা ক্ষেপণাস্ত্রগুলোতে হামলা করা হয়েছে এবং সেগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।’

 

এর আগে শনিবার রাতে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা ফোরদো, নাতাঞ্জ, ইসফাহানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করেছি।

 

ফোরদোতে মাটির তলায় পরমাণুকেন্দ্র ধ্বংস হয়ে গেছে।’

 

ইসরায়েল এর আগে ইরানের অন্য পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ করলেও ফোরদোতে আক্রমণ করেনি। এবার যুক্তরাষ্ট্র সেখানে আক্রমণ চালাল। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বাংকার বাস্টার বোমা আছে, যা মাটির নিচের স্থাপনাকেও গুঁড়িয়ে দিতে পারে।

 

সীমা লঙ্ঘন করেছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল : ইরান
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সীমা অতিক্রম করেছে বলে মন্তব্য করেছেন ইরানের শীর্ষ কূটনীতিক আব্বাস আরাঘচি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করতে রাশিয়া যাচ্ছেন ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ওআইসির এক বৈঠকের ফাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস বলেন, ‘(ইরানের) পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করে তারা সীমা অতিক্রম করেছে।’

ইসরায়েলের বোমা হামলার ৯ দিন পর, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে মার্কিন যুদ্ধবিমান। হামলার ঘটনা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে আমার কাছে এখনো সঠিক তথ্য নেই, তবে আমি মনে করি না এটি এখন আলোচ্য কিছু...কিন্তু গতরাতের আক্রমণ ছিল একটি গুরুতর অপরাধ।’

 

তিনি আরো বলেন, ‘এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর গুরুতর আঘাত করেছে।’

‘মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সব উপায়ে’ ইরান আত্মরক্ষা করবে বলে অঙ্গীকার করেন আব্বার আরাঘচি।

আইএইএর তদন্ত চায় ইরান
পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) তদন্ত করার দাবি জানিয়েছে ইরান। ইরানের এসএনএন নিউজ নেটওয়ার্কে এই খবর প্রচার হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আইএইএর প্রধান রাফায়েল গ্রোসিকে চিঠি লিখেছেন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান মোহাম্মদ এসলামি। চিঠিতে শনিবার রাতে মার্কিন হামলার তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

ইরানকে আলোচনার শুরুর আহ্বান জার্মান চ্যান্সেলরের
ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর রবিবার নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছেন জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মেৎস।

চ্যান্সেলরের মুখপাত্র স্টিফান কর্নেলিয়ুসের বলেছেন, ইরানকে ‘অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার এবং সংঘাতের একটি কূটনৈতিক সমাধানে আসার’ আহ্বান জানিয়েছেন মেৎস।

তিনি আরো বলেন, জার্মান সরকার বিশ্বাস করে, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির একটি বড় অংশ বিমান হামলায় প্রভাবিত হয়েছে।’ তবে তিনি আরো বলেন, এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে আরো সময় লাগবে।

ইরানকে আলোচনায় ফেরার আহ্বান যুক্তরাজ্যের
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ফলে সৃষ্ট নিরাপত্তা হুমকি ‘প্রশমনের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে’ যুক্তরাষ্ট্র।

এক্স অ্যাকাউন্টে তিনি লিখেছেন, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি।’

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, ‘ইরানকে কখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া যাবে না এবং যুক্তরাষ্ট্র সেই হুমকি দূর করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে।’

আলোচনা ভেস্তে দিয়েছে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র : ইরান
ইরানকে আলোচনায় বসতে ইউরোপীয় নেতাদের আহ্বানের জবাব দিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি। রবিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়েছেন তিনি।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই বিবৃতিতে প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘ইরান যেটা ছেড়ে আসেনি, সেখানে ফিরবে কিভাবে?’

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, ‘গত সপ্তাহে আমরা যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছিলাম, তখন ইসরায়েল তা ভেস্তে দেওয়ার পথ বেছে নেয়। এরপর এ সপ্তাহে এসে আমরা ইইউর সঙ্গে বসেছিলাম। তখন যুক্তরাষ্ট্র সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ভেস্তে দেওয়ার পথ বেছে নেয়।’

আরাঘচি আরো লিখেছেন, যুক্তরাজ্য ও ইইউর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরতে বলছেন। কিন্তু ইরান কিভাবে এমন কিছুতে ফিরে যেতে পারে, যা কখনো ছেড়ে আসেনি, কিংবা ভেস্তে দেয়নি?

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন মধ্যপ্রাচ্য
ইরানে মার্কিন হামলার জেরে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় কেমন প্রভাব তৈরি হতে পারে তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে লেবানন ও সৌদি আরব।

লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নওয়াফ সালাম বলেছেন, তার দেশের ‘সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থ’ হলো ‘যেকোনোভাবেই চলমান আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িত না হওয়া’।

এক্স অ্যাকাউন্টে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সৌদি আরব ‘ভ্রাতৃপ্রতিম ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের’ ওপর মার্কিন হামলাকে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। ‘সংযম ও উত্তেজনা এড়াতে সব ধরনের প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার’ গুরুত্ব তুলে ধরেছে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার পদক্ষেপ নেয়ার জোর আহ্বান জানিয়েছে দেশটি।

ইরানের ওপর মার্কিন হামলার নিন্দা জানিয়ে ইরাক বলেছে, এই হামলা ‘মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর ঝুঁকি’।

এ ছাড়া কাতার সতর্ক করে বলেছে, ‘এই অঞ্চলে বিরাজমান পরিস্থিতি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।’

সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে বিচক্ষণতা, সংযম ও আরো উত্তেজনা এড়াতে আহ্বান জানিয়েছে দোহার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলের হামলার আগে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে পারমাণবিক আলোচনার মধ্যস্থতাকারী ওমানও এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থায় বলা হয়েছে, মাস্কাট ‘ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি বিমান হামলার ফলে সৃষ্ট উত্তেজনার প্রতি গভীর উদ্বেগ, নিন্দা’ প্রকাশ করছে।

সোমবার আলোচনায় বসবেন কায়া কালাস
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের সব পক্ষকে পুনরায় আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক কায়া কালাস। তিনি বেশ জোর দিয়ে বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কালাস এক্সে পোস্টে লিখেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য সোমবার ইইউর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি বৈঠকে বসবেন।

তিনি আরো লিখেছেন, ‘ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া উচিত নয়, কারণ এটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে। আমি সব পক্ষকে পিছিয়ে আসার, আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার ও উত্তেজনা দমনের আহ্বান জানাচ্ছি।’

অন্যান্য দেশের প্রতিক্রিয়া
ভেনিজুয়েলার সরকার ইরানে মার্কিন হামলার স্পষ্টভাবে নিন্দা জানিয়েছে। টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিল বলেছেন, ‘ইসরায়েলের অনুরোধে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর মার্কিন সামরিক বাহিনী পরিচালিত বোমা হামলার ঘটনায় দৃঢ়ভাবে ও স্পষ্টভাবে নিন্দা জানাচ্ছে বলিভারিয়ান প্রজাতন্ত্র।’

কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল ডায়াজ-ক্যানেল এই হামলার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স চলমান উত্তেজনাকে এমন একটি সংকটের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা তার দেখা সবচেয়ে গুরুতর। তবে তার দেশ মার্কিন পদক্ষেপকে সমর্থন জানাচ্ছে কি না, তা বলতে রাজি হননি তিনি। তিনি বলেছেন, ‘সামরিক পদক্ষেপের চেয়ে কূটনীতি স্থায়ী সমাধান দিতে পারে।’

অস্ট্রেলিয়ান সরকার জানিয়েছে, তারা ‘উত্তেজনা কমানো, সংলাপ ও কূটনীতির আহ্বান অব্যাহত রাখবে।’ দেশটির সরকারের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।’

জরুরি সভা ডেকেছে আইএইএ
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার জরুরি সভা ডেকেছে জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। রবিবার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান রাফায়েল গ্রোসি জরুরি সভাটি ডেকেছেন। এক্স অ্যাকাউন্টে তিনি লিখেছেন, ‘ইরানের জরুরি পরিস্থিতির আলোকে আমি আগামীকাল (আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা) বোর্ড অব গভর্নরদের একটি জরুরি সভা আহ্বান করছি।’

তবে আইএইএ বলেছে, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর পরও ‘আশপাশের এলাকায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বাড়ার’ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ইরাকে মার্কিন দূতাবাস থেকে কর্মী সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে
ওয়াশিংটন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পর রবিবার একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আঞ্চলিক উত্তেজনার’ মধ্যে দূতাবাস থেকে কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ইরাকে নিজেদের কূটনৈতিক মিশন থেকে আরো কর্মী সরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

এএফপিকে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের চলমান প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২১ ও ২২ জুন অতিরিক্ত কর্মীরা ইরাক ছেড়েছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাড়তি সতর্কতা ও আঞ্চলিক উত্তেজনার কারণে’ গত সপ্তাহ থেকে কর্মী সরিয়ে নেওয়ার কাজটি শুরু হয়েছে।

ইরানের প্রতিবেশী দেশটিতে এখনো মার্কিন দূতাবাস ও কনস্যুলেট চালু রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর