‘চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী’

অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে মনে করে আদিবাসী ফোরাম।
ফোরামের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এখনো পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বরং বিগত ১০ মাস চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। তারা নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারে পরিণত হচ্ছে।
শুক্রবার (২০ জুন) রাজধানীর ধানমণ্ডিস্থ ওমেন ভলেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউভিএ) মিলনায়তনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আয়োজিত ‘সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এ তথ্য জানানো হয়। আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি অজয় এ মৃ’র সভাপতিত্বে সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক ও অধিকারকর্মী সতেজ চাকমা।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম নেতৃবৃন্দের পেশকৃত প্রথম স্মারকলিপির চার দফা দাবিনামাকে আমলে না নিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে থেকে মূলধারার বাঙালি জনগোষ্ঠী ঢুকিয়ে দিয়ে জুম্ম দমনের ‘হুমকির’ বিষয়টি বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। মূলতঃ তার এই আধিপত্যবাদী চিন্তার প্রতিফলনই দেশের রাজনৈতিক চরিত্রকে ভিন্ন এক রূপ দেয়।
অথচ ১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মৌল চেতনা এবং ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের মূলনীতির অন্যতম ছিল ‘অসাম্প্রদায়িকতা’।
সভায় জানানো হয়, সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় স্বাধীনতার পর থেকে পার্বত্য চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে নিহত, আহত ও অপহরণ কিংবা নিখোঁজের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ হাজার ১৪০ জন। নিহতদের মধ্যে এক হাজার ১৩৮ জন পাহাড়ি এবং এক হাজার ৪৪৬ জন বাঙালি। এই সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর ৩৮০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন।
অন্যদিকে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও ৮৯৯ জন পাহাড়ি, ৩৯০ বাঙালি এবং সামরিক-আধা সামরিক বাহিনীর ২৬ জনসহ এক হাজার ৩১৫ জন নিহত হয়েছেন।আহত হয়েছেন এক হাজার ৮২৩ জন। চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ১৯৮ জন। কিন্তু কোনো ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি।
জনসংহতি সমিতির তথ্য তুলে ধরে সভায় বলা হয়, পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে।
অবশিষ্ট ২৯টি ধারার সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত এবং ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। সভায় পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি ছয় দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, এই অঞ্চলের সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন করা ও পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘পাহাড়ি মানুষ কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে জড়াতে চায় না। কিন্তু আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে এখানেই থাকতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘বিগত সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমান সরকারেরও কোন উদ্যোগ নেই।’
‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, আদিবাসী শব্দটি নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। আদিবাসী নেই, এটা প্রচার করতে পারলে তাদের অধিকারের বিষয়টিও আর থাকে না। এই প্রবণতা বাদ দিয়ে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এই অঞ্চলজুড়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করার মধ্য দিয়ে যে ঘটনা ঘটবে তাতে জঙ্গিগোষ্ঠী, আধিপত্যবাদ বিস্তার পাবে। এর ফলে ওই অঞ্চলে আরো সামরিকীকরণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট, রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে।
সভায় আরো বক্তৃতা করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রমুখ।