img

শিরোনাম পড়ে তুলনাটা বেশিই মনে হবে। তবু ধৃষ্টতা দেখিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে টেম্বা বাভুমাকে তুলনা করা। বাস্তব জীবনে হাজারো প্রতিকূল পরিস্থিতির বিপক্ষে লড়াই করেছেন ম্যান্ডেলা। একটা সংখ্যা তার সারা জীবনের লড়াইকে ভালো করে ফুটিয়ে তোলে।

 

তা হচ্ছে ২৭ বছর জেলে কাটানো তার দুঃসহ স্মৃতি। এর বাইরে কত নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টকে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

 

তবু লক্ষ্য থেকে ম্যান্ডেলাকে বিচ্যুত করা যায়নি। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষকে এক করতে পেরেছিলেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা।

 

নেলসন ম্যান্ডেলা নামটা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ ছিল না। কেননা তার জীবনের পথটাই তো ছিল বন্ধুর। সেই তুলনায় স্পষ্টতই নগণ্য বাভুমা। এমনটা হয়তো খোদ দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটারও স্বীকার করবেন।

 

তবে আজ যে ইতিহাস গড়ছেন, তাতে ম্যান্ডেলার মতোই পুরো দক্ষিণ আফ্রিকাকে এক করেছেন তিনি। একটু আগ বাড়িয়ে বলা যায়, প্রোটিয়া সমর্থকদের বাইরে প্রতিপক্ষরাও হয়তো বাভুমাদের এই কীর্তিতে খুশি হয়েছেন।

 

হবেই না কেন। ক্রিকেট মানচিত্রেরই অন্যতম এক দল দক্ষিণ আফ্রিকা। হ্যান্সি ক্রনিয়ে-অ্যানাল্ড ডোনাল্ড-জ্যাক ক্যালিস-এবি ডি ভিলিয়ার্স-হাশিম আমলাদের মতো কিংবদন্তি তারকারা কত শত দুর্দান্ত ম্যাচই না উপহার দিয়েছেন।

 

কিন্তু দলীয় সাফল্য খুঁজতে গেলে তালিকার ক্রনিয়ে বাদে বাকিগুলোর নামের পাশে বড় এক জিরো। তাদের দীর্ঘ ক্রিকেট ইতিহাসে ১৯৯৮ সালে ক্রনিয়ের নেতৃত্বে জেতা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিটাই একমাত্র সাফল্য ছিল। এরপর একের পর এক আইসিসির টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলেও সেমিফাইনাল গণ্ডি পার হতে না পারার সেই দীর্ঘশ্বাস। একটা সময় তাই তাদের গায়ে জুড়ে গেল ‘চোকার্স’ তকমা। আর ট্রফি জয়ের অপেক্ষা বাড়তেই থাকল।

 

গেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অবশ্য ‘চোকার্স’ নামটা গা থেকে ঝেড়ে ফেলার দারুণ এক সুযোগ পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। শিরোপা জয়ের খুব কাছেও ছিল, ফাইনালটাও হাতের মুঠোয় ছিল তাদের। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করলেন জাশপ্রীত বুমরাহ নামক এক ‘ঘাতক’। ডেড ওভারে অবিশ্বাস্য বোলিংয়ে প্রোটিয়াদের মুখ থেকে ম্যাচ ছিনিয়ে নিয়ে ভারতকে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতালেন। পুরো আসরে দারুণ পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি হিসেবে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারও জিতলেন এই পেসার।

 

দীর্ঘ ২৭ বছরের সেই দুঃসহ যন্ত্রণা এবার ঘুচল দক্ষিণ আফ্রিকার। যেন চার দেয়ালে কাটানো ম্যান্ডেলার সেই ২৭ বছরের মুক্তির স্বাদের মতোই। ভাঙা হৃদয়ের টুকরাগুলোকে একেক করে জোড়া লাগানোর নায়কও ম্যান্ডেলার মতোই এক কৃষ্ণাঙ্গ, বাভুমা। ফ্যাফ ডু প্লেসিসের বদলে অধিনায়ক হওয়ার সময় থেকেই যিনি ট্রোলের শিকার হয়ে আসছেন। আর উচ্চতা, বর্ণ নিয়ে তো প্রায় সময়ই বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। সঙ্গে কোটা দিয়ে দলে খেলার খোটা তো ছিলই। তবে সব বিদ্রুপের বিপক্ষে মাথা উঁচু করে লড়াই চালিয়ে আসছেন প্রোটিয়াদের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক। সেই ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির বাভুমার ছোট্ট কাঁধেই বড় অর্জন প্রোটিয়াদের।

বাভুমার নেতৃত্বেই আজ ইতিহাস গড়ল দক্ষিণ আফ্রিকা। মাঝে গ্রায়েম স্মিথ-ডি ভিলিয়ার্সের মতো কত কিংবদন্তিই তো অধিনায়ক হয়েছেন, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্যটা কেউই এনে দিতে পারেননি। তবে কৃষ্ণাঙ্গ নেতৃত্বেই আবারও এক হলো পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা। ঠিক যেমনটা করেছিলেন ম্যান্ডেলা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল জয়েও লড়াইটা কম করতে হলো না বাভুমাকে। অধিনয়াকত্বের চাপ তো ছিলই। চাপটা আরো বাড়ে যখন অস্ট্রেলিয়ার ২১২ রানের বিপরীতে প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৩৮ রানে অলআউট হয় তারা। দ্বিতীয় ইনিংসে কাগিসো রাবাদা ও লুঙ্গি এনগিডির দুর্দান্ত বোলিংয়ে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের ২০৭ রানে অলআউট করে ম্যাচে ফেরে অবশ্য প্রোটিয়ারা। তবে চতুর্থ ইনিংসের লক্ষ্যটা কিন্তু কম নয়, ২৮২ রান। তিন শ ছুঁই ছুঁই স্কোরের সঙ্গে ফাইনালের চাপ বলে কথা। সঙ্গে বাজে অতীত তো ছিলই।  

 

বাভুমা যদি ‘রাজা’ হন তাহলে তার ‘সেনাপতি’ এইডেন মারক্রাম। প্রথম ইনিংসে ডাক মারা মারক্রামের মহাকাব্যিক সেঞ্চুরিতেই তো লর্ডসের ফাইনাল জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৯ উইকেট নেওয়া পেসার রাবাদার অবদানও অবশ্য কম নয়।

ঐতিহাসিক ট্রফি জয়ের ম্যাচে ১৩৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছেন মারক্রাম। তাতে যেন একটা আক্ষেপও ঘুচল তার। কেননা সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বেই শিরোপা খরা ঘোচার কথা ছিল প্রোটিয়াদের। সেটা মিস হলেও তারই অবিশ্বাস্য সেঞ্চুরিতে এবার আক্ষেপ ঘুচল।

 

লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখানো মারক্রামকে ফাইনাল জয়ে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন অধিনায়ক বাভুমা। এতটাই যে হামস্ট্রিংয়ের চোটে কাবু হওয়ার পরেও মাঠ ছাড়েননি ৩৫ বছর বয়সী ব্যাটার। যেন ‘যুদ্ধ’ জয় করতেই মাঠে থাকতে চান তিনি। সেই লক্ষ্যে ব্যাটকে তলোয়ারও বানান। এ জন্য অবশ্য স্টিভেন স্মিথ একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। কেননা ব্যক্তিগত ২ রানের সময় স্মিথই তাকে স্লিপে জীবন দিয়েছেন। ক্যাচ মিসের সঙ্গে পরে আঙুলে চোট নিয়ে মাঠও ছাড়তে হয় অজি ব্যাটারকে।

জীবন পাওয়ার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বাভুমাকে। যখন পেছনে তাকিয়েছেন তখন মারক্রামের সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে ১৪৭ রানের জুটি গড়ে ইতিহাস গড়ার গোড়াপত্তন করে দিয়েছেন বাভুমা। তবে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেননি তিনি। আজ ইতিহাস গড়তে নেমে গত দিনের সঙ্গে ১ রান যোগ করেই ৬৬ রানে ফিরেছেন তিনি। জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেনি ম্যাচের নায়ক মারক্রামও। জয় থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন ৬ রানে দূরে তখনই বাউন্ডারি হাঁকাতে গিয়ে মিড উইকেটে জশ হ্যাজলউডের বলে ট্রাভিস হেডের হাতে ক্যাচ দেন। ২০৭ বলের ১৩৬ রানের ইনিংসটি সাজিয়েছেন ১৪ চারে। স্মিথের (৪) পর চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি এখন মারক্রামের (৩)। অর্থাৎ যত চাপ, তত হেসেছে তার ব্যাট।

 

শেতাঙ্গদের বিপক্ষে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর কৃষ্ণাঙ্গদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন ম্যান্ডেলা। এবার ক্রিকেটের তীর্থ ভূমিতে কৃষ্ণাঙ্গদের মুখে আরেকবার বিজয়ের হাসি এনে দিলেন বাভুমা। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধি বলে কথা। ৫ উইকেটে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রোটিয়াদের উচ্ছ্বাসটাও ছিল দেখার মতো। কাইল ভেরেইনার যখন জয়সূচক শট হাঁকিয়ে ভোঁ দৌড় দিলেন তখন পুরো লর্ডস হাততালিতে মুখরিত হতে থাকল। অন্যদিকে লর্ডসের ব্যালকনিতে সতীর্থরা যখন উদযাপনে ব্যস্ত তখন দুই হাত মুখে আনন্দাশ্রু আটকাচ্ছিলেন বাভুমা। পরে একে-অপরে জড়িয়ে ধরে স্মরণীয় মুহূর্তটার আনন্দ ভাগাভাগি করেন।

ঠিক যেমন ক্লাব ও কিংবদন্তি খেলোয়াড়রা এ বছর দীর্ঘ ট্রফি খরা কাটিয়ে বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস করেছে বা করেছেন। ২৩ বছর পর বাংলাদেশের লিগ জিতেছে মোহামেডান, ১১৯ বছরের ক্লাব ইতিহাসে মেজর শিরোপা (এফএ কাপ) ক্রিস্টাল প্যালেসের, ৭০ বছর পর আবারও মেজর ট্রফি (কারাবাও কাপ) নিয়ে উচ্ছ্বাস নিউক্যাসলের। আর লিওনেল মেসি-নেইমার-কিলিয়ান এমবাপ্পেদের মতো কিংবদন্তিদের দিয়ে দল সাজিয়েও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পারা পিএসজিও তো এবারই স্বপ্ন ছুঁইল। 

 

অন্যদিকে ইউরোপা লিগ জিতে ১৭ বছর পর টটেনহামের ট্রফি জয়ের মধ্যে দিয়ে ঘুচেছে সন হিউং-মিনের আক্ষেপ। তারই সাবেক ক্লাব সতীর্থ হ্যারি কেইন বুন্দেসলিগার শিরোপা দিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রফি জিতেছেন। আর ১৮ বছর পর আইপিএল যেন পূর্ণতা পেয়েছে বিরাট কোহলির হাতে শিরোপা দেখে। সঙ্গে দুঃখ ঘুচেছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুরও। বিধাতা যেন এ বছরটাকেই তার গুডউইলে লিখে রেখেছিলেন দল ও খেলোয়াড়দের মুক্তি লাভের বছর হিসেবে।

এই বিভাগের আরও খবর