রাশিয়ার বিমানঘাঁটিতে হামলা, বিশ্বকে কী বার্তা দিল ইউক্রেন?

রাশিয়ার বিমানঘাঁটিগুলোর ওপর ইউক্রেনের সর্বাত্মক ড্রোন হামলা—‘অপারেশন স্পাইডারস ওয়েব’ ছিল এমন এক অভূতপূর্ব অভিযান, যার সাহসিকতা বা কৌশলগত চাতুর্যকে বাড়িয়ে বললেও অতিরঞ্জন হবে না। ইউক্রেন দাবি করছে, এই হামলায় রাশিয়ার ৭০০ কোটি ডলারের (৫২০ কোটি পাউন্ড) ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যদিও এ দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব নয়, তবে এটি যে অন্তত একটি চমকপ্রদ মনস্তাত্ত্বিক ও প্রচারণাগত বিজয়—তা বলাই যায়।
ইউক্রেনীয়রা ইতোমধ্যে এই হামলার তুলনা করছে অতীতের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সফলতার সঙ্গে—যেমন ২০২২ সালে রাশিয়ার ব্ল্যাক সি ফ্লিটের প্রধান যুদ্ধজাহাজ মস্কভা ডুবিয়ে দেওয়া বা কের্চ সেতুতে বোমা হামলা কিংবা ২০২৩ সালে সেভাস্তোপোল বন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ।
কীভাবে চালানো হলো অপারেশন?
ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এসবিইউ যে তথ্যগুলো গণমাধ্যমে ফাঁস করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে—‘অপারেশন স্পাইডারস ওয়েব’ ছিল এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পরিকল্পিত ও কৌশলগত অভিযান।
এই অভিযানের প্রস্তুতি নিতে সময় লেগেছে প্রায় ১৮ মাস। ইউক্রেন ছোট ছোট বহু ড্রোন চোরাইভাবে রাশিয়ায় পাঠায়, যেগুলো বিশেষ ট্রাকের ভেতরের গোপন চেম্বারে লুকিয়ে ছিল। সেই ড্রোনগুলো চারটি ভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়—যেগুলো একে অপরের থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে।
এরপর সেগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে কাছাকাছি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়।
ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক সেরহি কুজান ইউক্রেনীয় টেলিভিশনে বলেন, ‘বিশ্বের আর কোনো গোয়েন্দা সংস্থা এমন কিছু করেছে বলে শোনা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার এই কৌশলগত বোমারু বিমানগুলো আমাদের বিরুদ্ধে দূরপাল্লার হামলা চালাতে সক্ষম। তাদের মোট সংখ্যা মাত্র ১২০টি।
আমরা এর মধ্যে ৪০টিতে আঘাত করেছি—অবিশ্বাস্য একটি পরিসংখ্যান।’
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটা?
নির্দিষ্টভাবে বিমানগুলো ধ্বংস হয়েছে কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও সামরিক বিশ্লেষক ওলেক্সান্দর কোভালেঙ্কো মনে করেন, এর প্রভাব গভীর।
তিনি নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে লেখেন, ‘রাশিয়ার বর্তমান সামরিক-শিল্প কাঠামো এতটাই দুর্বল যে এই বিমানগুলো পুনর্নির্মাণ বা মেরামতের সামর্থ্য তাদের নেই।’ তিনটি প্রধান বোমারু বিমান—টিইউ-৯৫, টিইউ-২২ এবং টিইউ-১৬০—এর আর কোনো নতুন উৎপাদন হচ্ছে না বলে জানান তিনি। ফলে যেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো মেরামত কঠিন এবং প্রতিস্থাপন প্রায় অসম্ভব।
বিশেষ করে সুপারসনিক টিইউ-১৬০ বিমানের ক্ষতি রাশিয়ার জন্য ‘গভীর আঘাত’ হবে বলে উল্লেখ করেন কোভালেঙ্কো। তিনি লেখেন, ‘আজ রাশিয়ার অ্যারোস্পেস বাহিনী তাদের সবচেয়ে দুর্লভ দুটি বিমান হারিয়েছে—এগুলো যেন গোটা দলে দুটি ‘ইউনিকর্ন’।’
শুধু ক্ষতি নয়, স্পষ্ট বার্তাও
শুধু বিমানঘাঁটির ক্ষতি নয়, ইউক্রেন এই অভিযানের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে রাশিয়াকে আর পশ্চিমা মিত্রদেরও। ইউক্রেনের বিবিসি সার্ভিসের সাংবাদিক সভিয়াতোস্লাভ খোমেনকো বলেন, তিনি সম্প্রতি কিয়েভে এক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে এমন এক হতাশার গল্প শুনেছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আমেরিকানরা নিজেরাই বিশ্বাস করে নিয়েছে আমরা যুদ্ধ হেরে গেছি। আর তারা এই ধারণা থেকে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’
সামরিক সাংবাদিক ইলিয়া পোনোমারেঙ্কো এক্স (সাবেক টুইটার)–এ লেখেন, ‘এটাই ঘটে যখন একটি গর্বিত জাতি চারদিক থেকে শুনতে থাকে—‘ইউক্রেনের হাতে আর সময় নেই’, ‘তোমাদের কোনো ট্রাম্পকার্ড নেই’, ‘শান্তির জন্য আত্মসমর্পণ করো, রাশিয়া হারবে না’। কিন্তু তারা শোনে না। তারা লড়ে যায়।’
ব্যবসায়ভিত্তিক ম্যাগাজিন বিজনেস ইউক্রেন এই অভিযান নিয়ে লিখেছে, ‘শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ইউক্রেনের হাতে কিছু ‘কার্ড’ আছে—আজ জেলেনস্কি খেললেন ‘ড্রোনের রাজা’।’
বার্তা নিয়ে ইস্তানবুলে শান্তি আলোচনা
এই বার্তাই এখন ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা নিয়ে যাচ্ছেন তুরস্কের ইস্তানবুলে, যেখানে রাশিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার আরেক দফা শুরু হতে যাচ্ছে। ওই সরকারি কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘আমেরিকানরা এমনভাবে আচরণ করছে যেন তাদের কাজ হলো আমাদের জন্য সবচেয়ে ‘সফট’ আত্মসমর্পণের শর্ত ঠিক করে দেওয়া। আর তারপর তারা রাগ করে যখন আমরা তাদের ধন্যবাদ দিই না। কিন্তু আমরা তো হারিনি—আমরা বিশ্বাস করি না যে আমরা হারিয়ে গেছি।’
ডনবাসের যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার ধীর কিন্তু অবিচল অগ্রগতি থাকা সত্ত্বেও ইউক্রেন জানিয়ে দিচ্ছে—কিয়েভকে এত সহজে খারিজ করা যাবে না। অপারেশন স্পাইডারস ওয়েব শুধু একটি ড্রোন হামলা নয়, বরং এটি ছিল ইউক্রেনের আত্মবিশ্বাস, কৌশল ও বার্তা—‘আমরা এখনো লড়ছি।’
সূত্র : বিবিসি