নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দ.কোরিয়া

ছয় ঘণ্টার জরুরি সামরিক আইন, শত শত দিনের বিক্ষোভ, সিউলের আদালতে সংঘর্ষ ও প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের অভিশংসনের পর দক্ষিণ কোরিয়া এখন একটি নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ৪ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার ভোটার পাঁচজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মধ্যে একজনকে বেছে নেবেন।
ভোটের শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এগিয়ে রয়েছেন বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী লি জে-ম্যুং। তার পরেই রয়েছেন ক্ষমতাসীন পিপল পাওয়ার পার্টির প্রার্থী কিম মুন-সু।
সর্বশেষ গ্যালাপ কোরিয়ার জরিপ অনুযায়ী, লি পেয়েছেন ৪৯ শতাংশ জনসমর্থন, যেখানে কিমের পেছনে রয়েছে ৩৬ শতাংশ সমর্থন।
ইউনের পতনের পর নতুন নেতৃত্বে আশার আলো
সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল গত সপ্তাহে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে পঞ্চম দফায় আদালতে হাজির হন। অভিযোগ, গত ৩ ডিসেম্বর তিনি ব্যর্থভাবে সামরিক আইন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। দোষী প্রমাণিত হলে ইউনের সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে আজীবন কারাদণ্ড, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও।
এই সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা পুরো দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে দুইভাগে ভাগ করে দিয়েছে—একদল ইউনের পক্ষে, অন্য দল চরমভাবে তার বিরোধী। এই বিভাজনের মধ্যেও এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আগাম ভোটে অংশগ্রহণের হার ছিল দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ—৩৪.৭৪ শতাংশ। বিদেশি ভোটারদের মধ্যে ৭৯.৫ শতাংশ ভোট দিয়েছেন, যা রেকর্ড।
দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতির দৌড়ে লি জে-ম্যুং
২০২২ সালের নির্বাচনে ইতিহাসের সবচেয়ে কাছাকাছি ব্যবধানে লি হেরে যান ইউনের কাছে, মাত্র ০.৭৩ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার দুই বছর পর আবারও সর্বোচ্চ পদে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যেই তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে একাধিক মামলা, দুর্নীতির অভিযোগ, এমনকি এক সংবাদ সম্মেলনে গলায় ছুরি হামলারও শিকার হন তিনি।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত মাসখানেক আগে তাকে নির্বাচনী প্রচারে মিথ্যাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করে, কিন্তু নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত মামলার শুনানি স্থগিত করা হয়। এখন তিনি সুরক্ষাবলয় ঘেরা বুলেটপ্রুফ কাচের পেছনে থেকে প্রচার চালাচ্ছেন, ছাদে স্নাইপার, চারপাশে বাহিনী।
তাকে সমর্থন জানাতে এবার অনেক রক্ষণশীল রাজনীতিকও পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কিম মুন-সুর দলের সংসদ সদস্য কিম সাং-উক দল ত্যাগ করে ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যোগ দেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান গণমাধ্যম হানকিওরেহ প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২২ সালে ইউনকে যারা ভোট দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এবার মাত্র ৫৫ শতাংশ কিমকে সমর্থন করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউনের ব্যর্থ সামরিক শাসন পরিকল্পনার পরে রক্ষণশীলদের মধ্যে ব্যাপক আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, যার ফল লির দিকে জনমতের ধাবিত হওয়া।
সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ, ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্টের জন্য ‘ভারী বোঝা’
কেইমিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অধ্যাপক লিম উন-তায়েক বলেন, ‘সামরিক আইন, বিদ্রোহের চেষ্টা ও অভিশংসন প্রক্রিয়া আমাদের গণতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে’। তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল কমিশনের সাবেক সদস্যও। তিনি বলেন, ‘নতুন প্রেসিডেন্টকে দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটি ভারী বোঝা কাঁধে নিতে হবে।’
দেশে বেকারত্ব, সামাজিক বৈষম্য ও জলবায়ু সংকট—তিনটিই এখন বড় ইস্যু। গবেষণা অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ার ৩৮ শতাংশ কর্মজীবীই চুক্তিভিত্তিক বা খণ্ডকালীন শ্রমিক। লি ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ব্যবসাবান্ধব নীতির মাধ্যমে গবেষণা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে বিনিয়োগ বাড়াবেন। অতীতে বামপন্থী ভাবধারার সমর্থক হলেও এখন তিনি বিতর্কিত সামাজিক ইস্যু থেকে দূরে থাকছেন, যেমন: লিঙ্গবিষয়ক রাজনীতি। একসময় সার্বজনীন মৌলিক আয়ের পক্ষে থাকলেও বর্তমানে তা থেকে সরে এসেছেন।
সামরিক আইনের রাতের ঘটনাতেই ‘নায়ক’ হয়ে ওঠা
৩ ডিসেম্বর সামরিক আইন ঘোষণার রাতে লি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির দেয়াল বেয়ে উঠে ভেতরে ঢুকে সংসদ সদস্যদের সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ভোট দিতে আহ্বান জানান। এই দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার হওয়ায় তিনি জনগণের কাছে গণতন্ত্রের যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পান।
লি তার প্রচারণায় অঙ্গীকার করেছেন, ইউনের সামরিক আইন ষড়যন্ত্রে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনবেন। সেইসঙ্গে ভবিষ্যতে কোনো প্রেসিডেন্ট যেন এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন, সে জন্য আইন কঠোর করবেন। তিনি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ বর্তমান একক পাঁচ বছরের পরিবর্তে দুটি চার বছর মেয়াদে করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যদিকে কিম মুন-সু এ ধরনের অনেক নীতির সঙ্গে একমত পোষণ করলেও বলেছেন, ইউনের অভিশংসন ‘অত্যন্ত চরম পদক্ষেপ’ ছিল।