সৌদিতে ‘অবাধ্য নারীদের জন্য গোপন কারাগার’, কী হয় সেখানে

একজন তরুণী, যার পরনে কালো আবায়া, তাকে দেখা গেছে সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি শহরে দ্বিতীয় তলার জানালার কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকতে। আরেকটি ছবিতে দেখা গেছে, একদল পুরুষ তাকে ক্রেনের সাহায্যে নিচে নামিয়ে আনছেন।
ওই তরুণীর পরিচয় অজানা, তবে ধারণা করা হচ্ছে, তাকে রাখা হয়েছিল সৌদি আরবের গোপন ‘কারাগারগুলোর’ একটিতে—যেখানে পরিবারের নির্দেশ অমান্য করা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক রাখা অথবা বাড়ি থেকে পালানোর মতো ‘অপরাধে’ মেয়েদের পাঠানো হয়।
এ ধরনের কেন্দ্রগুলোকে সৌদি সরকার ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’ অভিহিত করলেও, বাস্তবে এগুলো নারীদের মানসিকভাবে দমন ও শাস্তি দেওয়ার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাধারণত এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা বা এসব ‘কেয়ার হোম’ সম্পর্কে তথ্য ও ছবি প্রকাশ করা কঠিন। নারীদের অধিকার বিষয়ে মুখ খুললেই সেখানে নিঃশব্দে দমন-পীড়ন নেমে আসে। তবে গত ছয় মাস ধরে দ্য গার্ডিয়ান যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছে, তাতে উঠে এসেছে ভয়ংকর সব চিত্র—প্রতি সপ্তাহে বেত্রাঘাত, ধর্মীয় বাধ্যতামূলক শিক্ষা, বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবন এবং নানাবিধ মানসিক-শারীরিক নির্যাতন।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই আত্মহত্যা করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন।
বহু নারী সেখানে বছরের পর বছর ধরে আটক থাকেন—যতক্ষণ না পরিবারের পুরুষ অভিভাবক তাদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
একজন তরুণী বলেন, ‘প্রতিটি মেয়ে, যারা সৌদি আরবে বড় হয়েছে, তারা জানে দার আল-রেয়া কতটা ভয়ংকর। এটা যেন নরক। আমি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম, যখন শুনেছিলাম আমাকে ওখানে পাঠানো হবে।
জানতাম, সেখানে কী হয়—আর ভাবলাম, আমি বেঁচে থাকব না।’
লন্ডনপ্রবাসী সৌদি অধিকারকর্মী মরিয়ম আলদোসারি বলেন, ‘একজন নারীকে ওখানে রাখা হয় যত দিন না সে পরিবারের নিয়ম মেনে চলতে রাজি হয়।’
যখন সৌদি আরব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংস্কারের মুখোশ পরে ফিফা বিশ্বকাপের মতো ইভেন্ট আয়োজন করছে, তখন নারীদের অধিকারের দাবিতে মুখ খোলা নারীদের গৃহবন্দি, জেল কিংবা দেশান্তর করা হচ্ছে। এই পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো হচ্ছে নারীদের দমন করার অন্যতম গোপন অস্ত্র, যা বিশ্বের কাছ থেকে লুকানো থাকে।
একজন নারী অধিকারকর্মী সারাহ আল-ইয়াহিয়া, যিনি এই কেন্দ্রগুলো বন্ধের জন্য একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন, তিনি বলেন—মেয়েদের সেখানে পৌঁছানোর পরই স্ট্রিপ-সার্চ, কৌমার্য পরীক্ষা এবং ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, ‘এটা কোনো পুনর্বাসনকেন্দ্র নয়, এটা একদম জেলখানা। সবাইকে নম্বরে ডাকা হয়—‘নম্বর ৩৫, সামনে আসো’। যদি কেউ নিজের পারিবারিক নাম বলে ফেলে, তাকে বেত্রাঘাত করা হয়। নামাজ না পড়লে বেত্রাঘাত। কেউ একা আরেক মেয়ের সঙ্গে থাকলেও তাকে সমকামী বলা হয় এবং শাস্তি পেতে হয়।’
এক তরুণী জানান, তার বাবা তাকে যৌন নির্যাতনে বাধ্য করতে দার আল-রেয়ার ভয় দেখাতেন। ‘আমার কাছে তখন দুটোই ভয়াবহ ছিল—বাড়িতে থেকে নির্যাতনের শিকার হওয়া, না হয় ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে যাওয়া।’
একজন নারীর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একটি নির্যাতিত মেয়েকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এক নারীকে ছয় মাসের জেল দেওয়া হয়। সৌদি আইনে একজন নারী ‘বাড়ি থেকে পালিয়েছে’ এমন অভিযোগ থাকলে তাকে আশ্রয় দেওয়া অপরাধ।
‘যদি আপনার ভাই বা বাবা আপনাকে যৌন নির্যাতন করে বা গর্ভবতী করে ফেলে, তাহলে পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে আপনাকেই দার আল-রেয়াতে পাঠানো হবে,’ বলেন তিনি।
২৫ বছর বয়সী আমিনা নামের এক তরুণী জানান, বাবা তাকে মারধর করার পর তিনি নিজেই বরাইদাহ শহরের এক পুনর্বাসনকেন্দ্রে আশ্রয় চান। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ ছিল ‘জীর্ণ-পুরাতন, ভয়ানক’ এবং স্টাফরা ছিল ‘নির্দয় ও অমানবিক’। তাকে বলা হয়, অন্যদের অবস্থা নাকি আরো খারাপ—তারা ‘শিকলে বাঁধা অবস্থায় বাড়িতে আটকে’ থাকেন।
পরদিন তার বাবাকে ডেকে পাঠানো হয়। কেন্দ্রে তাদের দুজনকে ‘শর্ত’ লিখতে বলা হয়। আমিনা লেখেন, তিনি মার খাবেন না, জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে না এবং চাকরি করতে পারবেন। কিন্তু তার বাবা লিখলেন, তিনি যেন কাউকে অসম্মান না করেন, কোনো অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে না যান এবং সব সময় একজন পুরুষ অভিভাবকের সঙ্গে থাকেন। আমিনা ভয়ে রাজি হয়ে সই করেন।
বাসায় ফিরে যাওয়ার পর নির্যাতন আরো বাড়ে। অবশেষে আমিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তিনি বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ একা, ভীত ছিলাম। নিজের বাড়িতেই যেন বন্দি ছিলাম, কেউ আমাকে রক্ষা করবে না—এমন মনে হতো। মনে হতো, আমার জীবন কোনো মূল্যই রাখে না। কিছু খারাপ হলে কেউ মাথাও ঘামাবে না।’
এই কেন্দ্রে যাওয়ার ভয় মেয়েদের মনে ছোটবেলা থেকেই গেঁথে দেওয়া হয়। ১৬ বছরের শামস জানান, একবার তাদের স্কুলে দার আল-রেয়া থেকে এক নারীকে এনে অভিজ্ঞতা শোনানো হয়। তিনি বলেন, একজন ছেলের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তাকে ধর্মীয় পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এরপর গর্ভবতী হলে পরিবার তাকে ত্যাগ করে, ছেলেটিও বিয়েতে রাজি না হওয়ায় তাকে দার আল-রেয়ায় পাঠানো হয়।
তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘একজন নারী যদি শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়, সে সস্তা হয়ে যায়। একজন পুরুষ পুরুষই থাকবে, কিন্তু একবার সস্তা হয়ে গেলে, নারী সারাজীবন সস্তা হয়েই থাকবে।’
লায়লা নামে এক তরুণী এখনো দেশের মধ্যেই বাস করছেন। তিনি জানান, যখন তিনি পুলিশকে তার বাবা ও ভাইদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তখন তাকে দার আল-রেয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি বলেন, তার পরিবার তাকে নির্যাতন করত এবং পরে তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের অধিকার নিয়ে পোস্ট দেওয়ার জন্য পরিবারের সুনাম নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়। তার বাবার সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত তিনি সেই আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতেন – যদিও তার বাবাই ছিলেন তার উপর নির্যাতনের অভিযুক্ত ব্যক্তি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সৌদি নারী অধিকারকর্মী বলেন, ‘এই নারীদের পাশে কেউ নেই। অপরাধ না করেও তারা বছরের পর বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকতে পারেন। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ হচ্ছে : পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি, বিয়ে, অথবা ভবন থেকে লাফ দেওয়া। অনেক বৃদ্ধ অথবা সাজাপ্রাপ্ত পুরুষ, যারা বিয়ে করতে পারেনি, তারা এসব প্রতিষ্ঠানে কনে খুঁজে বেড়ায়। অনেক নারী এই প্রস্তাব মেনে নেয় শুধু মুক্তির উপায় হিসেবে ‘
কিছু সৌদি পুরুষ বলবে, ওই নারী এমন শাস্তিরই যোগ্য বা তারা কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সরকার যে তাদের সুরক্ষার জন্য এই সুবিধা দিচ্ছে, বলেন ২০২২ সালে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হওয়া অধিকারকর্মী ফাওজিয়া আল-ওতাইবি।
তিনি বলেন, কেউ এই জায়গাগুলোর কথা প্রকাশ্যে বলে না বা টুইট করে না। যখন আপনি সেখানে যান, কেউ আপনার খোঁজ রাখে না। ভুক্তভোগীদের এমনভাবে লজ্জা দেওয়া হয় যেন তারাই দোষী।
অধিকারকর্মীরা বলেন, সৌদি সরকার যদি সত্যিই নারীদের অধিকার নিয়ে আন্তরিক হতো, তাহলে তারা এই ‘কেয়ার হোম’ ব্যবস্থা সংস্কার করত এবং নির্যাতনের শিকারদের জন্য প্রকৃত নিরাপদ আশ্রয় দিত। অনেক নারীর পরিবার ভালো, তারা নির্যাতন করে না বা তাদের লুকিয়ে রাখে না। কিন্তু বহু নারী কঠোর বিধি-নিষেধে বাস করে এবং চুপচাপ নির্যাতন সহ্য করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে রাষ্ট্র এই নির্যাতনকে সমর্থন করছে। এগুলো শুধু নারীদের প্রতি বৈষম্য করার জন্যই রয়েছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ কেন এগুলো বন্ধ করছে না?
মানবাধিকার সংস্থা এএলকিউএসটি বলেছে, দার আল-রেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো সৌদি আরবে কুখ্যাত – এগুলো রাষ্ট্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় লিঙ্গ-নিয়ম কার্যকর করতে এবং ‘নারীর ক্ষমতায়নের সৌদি বর্ণনার পুরো বিপরীত’।
সংস্থাটির ক্যাম্পেইন কর্মকর্তা নদীন আবদুল আজিজ বলেন, ‘যদি তারা সত্যিই নারীর অধিকার এগিয়ে নিতে চায়, তাহলে তাদের উচিত এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা এবং নির্যাতিতদের রক্ষা করে এমন প্রকৃত আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা।’
এদিকে সৌদি সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, দেশে একটি বিশেষায়িত কেয়ার সুবিধার নেটওয়ার্ক রয়েছে যা নারী ও শিশুদের মতো দুর্বল গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করে – যারা গৃহস্থালির সহিংসতার শিকার হয়েছে।
তিনি জোর দিয়ে জবরদস্তিমূলক আটক, নির্যাতন বা বাধ্যবাধকতার অভিযোগ ‘সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার’ করেন। তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো আটক কেন্দ্র নয়। এখানে যে কোনো নির্যাতনের অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় এবং তা পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত করা হয়। এখানকার নারীরা স্কুল, কর্মস্থল বা ব্যক্তিগত কাজে যেকোনো সময় বাইরে যেতে পারেন এবং অভিভাবক বা পরিবারের সদস্যের অনুমতি ছাড়াই স্থায়ীভাবে বেরিয়ে যেতে পারেন।
সরকার আরো জানিয়েছে, পারিবারিক নিপীড়নের অভিযোগ গোপনীয় হটলাইনের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় এবং প্রত্যেকটি কেস দ্রুত সমাধান করে ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।