img

দীর্ঘকাল ‘অরাকল অব ওমাহা’ নামে খ্যাত বিশ্বের অন্যতম সফল বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট এবার অবসরে যাচ্ছেন। ৯৪ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি গতকাল শনিবার ঘোষণা দিয়েছেন, চলতি বছরের শেষেই তিনি বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। তার উত্তরসূরি হিসেবে তিনি গ্রেগ এবেলকে এই পদে সুপারিশ করবেন।

ওয়ারেন বাফেট ৬০ বছর ধরে বার্কশায়ারের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

এই দীর্ঘ সময়ে তিনি নিজেকে একজন বিলিয়নিয়ারে পরিণত করেছেন এবং তার সাফল্যের গল্প আমেরিকার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন।

 

বিনিয়োগে ধৈর্যের জয়

বাফেট কখনও ঝুঁকিপূর্ণ বা জটিল আর্থিক কৌশল গ্রহণ করেননি। বরং তিনি গ্রহণ করেছেন ‘বাই অ্যান্ড হোল্ড’—অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সহজ কিন্তু সুচিন্তিত কৌশল। এভাবেই গড়ে তুলেছেন নেব্রাস্কাভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে—যার আওতায় রয়েছে ডিউরাসেল ব্যাটারি, জাইকো ইনস্যুরেন্স, পেইন্ট ব্র্যান্ড, এমনকি হীরাও।

এ ছাড়াও, কম্পানিটি কোকা-কোলা, শেভরন, অ্যাপল ও আমেরিকান এক্সপ্রেসের মতো মার্কিন কর্পোরেট জায়ান্টদের শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে, অনেকটাই নিখুঁত নির্বাচনের মাধ্যমে।

 

সরল জীবন

ফোর্বস ম্যাগাজিনের শনিবারের রিয়েল-টাইম তালিকা অনুযায়ী, ওয়ারেন বাফেটের সম্পদের পরিমাণ ১৬৮.২ বিলিয়ন ডলার—বিশ্বে পঞ্চম সর্বোচ্চ। তবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও তিনি জীবনযাপন করেছেন অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে। এখনো থাকেন ওমাহার একটি নিরিবিলি পাড়ার সেই পুরনো বাড়িতে।

যে বাড়িটি তিনি ১৯৫৮ সালে মাত্র ৩১ হাজার ৫০০ ডলারে কিনেছিলেন।

 

খাবারেও রয়েছে সাধারণতা—সপ্তাহে অন্তত তিনবার ম্যাকডোনাল্ডসের চিকেন নাগেট, স্ন্যাকসে আলুর চিপস, ডেসার্টে আইসক্রিম এবং প্রতিদিন গড়ে পাঁচ ক্যান কোকা-কোলা। শখের তালিকায় আছে ব্রিজ খেলা ও ইউকুলেলে বাজানো।

২০১৩ সালে সিবিএসকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বিলাসবহুল পোশাক লাগে না, দামি খাবারও না।’ তবে ২০০৬ সালে তিনি স্বীকার করেন, একটি প্রাইভেট জেট কিনেছেন—জীবনকে সহজ করার জন্য।

 

দানশীলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

২০০৬ সালে তিনি ঘোষণা দেন, তার সম্পদের ৯৯ শতাংশই তিনি দান করে দেবেন। এরপর বন্ধু ও ব্রিজ পার্টনার বিল গেটসের সঙ্গে মিলে অন্য বিলিয়নিয়ারদেরও তাদের সম্পদের অর্ধেক দানের অঙ্গীকার করাতে অনুপ্রাণিত করেন।

এই উদ্যোগ তাকে যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। প্রতিবছর বসন্তে ওমাহায় আয়োজিত বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের বার্ষিক সভা  ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে সাহায্য করেছে। এই সমাবেশকে ‘উডস্টক ফর ক্যাপিটালিস্টস’ বলা হয়।

তিনি নিয়মিত অর্থনৈতিক নীতিমালা, বিটকয়েনের সম্ভাব্যতা বা ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি নিয়ে মন্তব্য করেছেন। বরাবরই তিনি দাবি করে এসেছেন, তার মতো ধনীদের বেশি কর দেওয়া উচিত।

ব্যবসায়িক সূচনালগ্ন

ওয়ারেন বাফেট ১৯৩০ সালের ৩০ আগস্ট, ওমাহায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলাতেই ব্যবসায় আগ্রহ জন্মে— ‘ওয়ান থাউজেন্ড ওয়েজ টু মেক ১,০০০ ডলার’ বইটি পড়ে। শৈশব একেবারে সহজ ছিল না তার। নিজের বর্ণনায় তিনি উল্লেখ করেছেন, এক সময় চুরি করার প্রবণতা এবং কঠোর মায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলার সংগ্রামের কথা। পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেও, তার বাবা (একজন ব্যবসায়ী ও কংগ্রেস সদস্য) তা হতে দেননি।

বাফেট ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় পড়াশোনা শুরু করে পরে ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কা থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৫১ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন।

বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের উত্থান

১৯৫০-এর দশকে ওয়াল স্ট্রিটে কাজ শুরু করেন বাফেট। এরপর ‘বাফেট পাটনারশিপ’ গড়ে তোলেন। এটি ১৯৬৫ সালে এক টেক্সটাইল কম্পানির সঙ্গে একীভূত হয়। পাঠকপ্রিয় ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনগুলো পড়তে পড়তেই বাফেট ধীরে ধীরে এমন বিনিয়োগের দিকে এগিয়ে যান যেগুলোর বাজার মূল্য কম, কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ছিল বিশাল।

তার পরিশ্রমে বার্কশায়ার ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক বিশাল বিনিয়োগ সাম্রাজ্যে, যেখানে ব্যাংকিং, জ্বালানি, খাদ্য, প্রযুক্তি ও এয়ারলাইনের মতো খাতেও রয়েছে অবদান।

শেষ অধ্যায়ে

৯০ বছর বয়সে (২০২১ সালে) তিনি গ্রেগ এবেলকে তার উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষিত করেন এবং এখন সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় এসেছে। বাফেট ১৯৫২ সালে স্যুজান বাফেটকে বিয়ে করেন। তবে তার স্ত্রী ২০০৪ সালে মারা যান। তাদের তিন সন্তান রয়েছে। পরবর্তীতে তিনি তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী অ্যাস্ট্রিড মেন্কসকে ২০০৬ সালে বিয়ে করেন।

ওয়ারেন বাফেট শুধু এক সফল বিনিয়োগকারী নন, তিনি এক মূল্যবোধের প্রতীক। সম্পদ, সাধনা, সরলতা ও সদিচ্ছার অনন্য মিশেলে তার জীবন এক প্রেরণার নাম হয়ে থাকবে বিশ্বের লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে।

সূত্র : এএফপি

এই বিভাগের আরও খবর