শীতে শিশুর যত্নে করণীয়

বাংলাদেশে পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস হলো শীতকাল অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ সময় কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের প্রকোপ সব বয়সের মানুষকেই কাবু করে ফেলে। শীতকালে আর্দ্রতা কমে যায়, বাতাসে ধুলাবালি বেশি ওড়ে, তাই সর্দি-কাশি, অ্যাজমা বা হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস ও ব্রঙকিউলাইটিসের প্রকোপ বেশি হয়। বড়দের চেয়ে শীতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে শিশুদের শরীরে।
বাবা-মা হিসাবে আমরা বাচ্চাদের যতই সাবধানে রাখি না কেন এই শীতের মরসুমে শিশুদের অনেক বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয়।
শীতকালে সাধারণত বিভিন্ন প্রকার ফ্লু দেখা দেয়। দেহের বাইরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় শরীর তাপ হারাতে থাকে। এর ফলে শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ফ্লু সংক্রমণের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
এ ছাড়াও ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় ঠাণ্ডা, জ্বর, সর্দি-কাশিসহ শিশুর ত্বক রুক্ষ ও নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। শুষ্ক চামড়া বাচ্চাদের বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দেয়। তাই এ সময় ভয় না পেয়ে শিশুদের যত্নে বাবা-মাকে আরো বেশি মনোযোগী হতে নির্দেশ দেন চিকিৎসকরা।
আমাদের মাঝে একটি ভুল ধারণা হলো শীতকালে শিশুদের কম গোসল করানো। বরং, চিকিৎসকেরা নির্দেশ দেন হালকা গরম পানিতে শিশুকে প্রতিদিন গোসল করাতে। এতে করে অ্যালার্জি হওয়া থেকে বিরত থাকবে এবং নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারে শিশুর ত্বক থাকবে সতেজ। এ ছাড়াও, শিশুকে প্রতিদিন সূর্যস্নানে রেখে দিন এবং সূর্যস্নানে খেয়াল রাখতে হবে যে দুপুরের তীক্ষ্ণ রোদের চেয়ে সকালের মিষ্টি রোদটাই উত্তম, এতে করে শিশুর ভিটামিন-ডি-এর চাহিদা পূরণ হবে।
শিশু যে ঘরে থাকে সেখানে যাতে নিয়মিত আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
অন্ধকার ও স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে শিশুদের অসুস্থতার হার বেড়ে যায়। একইসাথে, ঘরে যাতে শীতের কনকনে হাওয়া না ঢুকে সেদিকেও বাবা-মাকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। শোয়ার সময় লেপ বা কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। আবার অতিরিক্ত গরম কাপড়ের জন্য যাতে ঘেমে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শীতে বেশিক্ষণ যেন শিশু বাড়ির বাইরে না থাকে কিংবা খেলাধুলা না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সন্ধ্যার পর অতি জরুরি কাজ ব্যতীত শিশুকে বাহিরে না যাওয়াই উত্তম।
বাড়ির বাইরে নিতে হলে শিশুকে যথেষ্ট গরম কাপড় পরিয়ে নিতে হবে। শিশুর মাথা, গলা ও কান শীতের পোশাকে ঢেকে বাইরে হওয়া উচিত। শিশুকে গরম কাপড় পরানোর আগে অবশ্যই একটি সুতির জামা পরানো উত্তম, এতে করে শিশুর ত্বকে গরম কাপড়জনিত র্যাশ হওয়া থেকে বাঁচানো সম্ভব। শীতে শিশুকে হাতে দস্তানা এবং পায়ে অবশ্যই মোজা পরাতে হবে। ত্বকের সুরক্ষায় শিশুর ঠোঁটে লিপবাম এবং হাত পায়ে ভেসলিন লাগানো যেতে পারে। শিশুদের জন্য কয়েক জোড়া শীতের কাপড় ব্যবহার করতে হবে এবং দুই থেকে তিন দিন অন্তর অন্তর তা পরিষ্কার করে ধুয়ে ভালো করে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
আপনার শিশুকে শীতকালে বেশি বেশি ফলমূল, শাকসবজি ও সুষম খাদ্য খাইয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করুন তাতে করে আপনার বাচ্চার শুধু শীতের রোগ না বরং অন্য সকল রোগের ঝুঁকিও কমে যাবে। এই মৌসুমে নানান রকমের রোগ বালাই থেকে দূরে থাকতে ছোট্ট সোনামণিদের খাওয়ান মৌসুমি ফল ও সবজি। মূল কথা বাচ্চার ভিটামিন প্রাকৃতিকভাবেই পূরণ করুন। এ ছাড়াও, শিশুকে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়ান। বুকের দুধ রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়। ফলে শিশু সহজে ঠাণ্ডা-কাশি ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয় না।
পরিবারের কোনো সদস্যের বা কোনো আত্মীয়ের সর্দি, কাশি, ভাইরাল জ্বর ইত্যাদি থাকে, তবে তারা মা ও নবজাতক শিশুর কাছে আসা থেকে বিরত থাকতে হবে। নবজাতক শিশুর সামান্য কাশি বা হাঁচিও কিন্তু সন্দেহজনক। তাই কাশি, শব্দ করে শ্বাস টানা, দুধ টেনে খেতে না পারা, শ্বাস নিতে কষ্ট বা পাঁজর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেঁকে যেতে থাকলে অতি দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
লেখক: ডা. নুসরাত ফারুক, সিনিয়র কনসালটেন্ট, পেডিয়াট্রিক্স ও নিওন্যাটোলজি
নিওনেটাল ইন্টেনসেভিস্ট, এভারকেয়ার হসপিটাল