img

আর দশটা কিশোরের মতোই বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল নাজি আল বাবার। ঠিক রোনালদোর মতো ফুটবলার হতে চাইত সে। তবে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের এই কিশোরের সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি দখলদার ইসরায়েল। দিন-দুপুরে তার শরীরে বিদ্ধ হয়েছে ইসরায়েলি ঘাতক বাহিনীর ছোড়া চার চারটি গুলি।

আরবি নাজি যার অর্থ ‘বেঁচে থাকা’ (সারভাইভার), তবে সেই নাজিকে বাঁচতে দেয়নি ইসরায়েল। 

১৪ বছরের সদা হাস্যোজ্জ্বল নাজি বয়সের তুলনায় ছিল বেশ লম্বা। সে ছিল শান্তশিষ্ট, একজন দয়ালু ও পরোপকারী কিশোর। তার স্বপ্নে ছিল ফুটবল।

হেব্রনের কিছুটা উত্তরে হালহুলে অবস্থিত স্পোর্টস ক্লাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত অনুশীলনে। স্কুল শেষে প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে ভালোবাসত সে।

নিজের বয়সের তুলনায় একটু বেশি লম্বা হয়ে গেছে নাজি; বন্ধু বা প্রিয়জনের কোনো অনুরোধ কখনো প্রত্যাখ্যান করত না— মা সামাহার আল-জামারার মনে সেই স্মৃতি এখনো জীবন্ত।  

 

৪০ বছর বয়সী এই নারী বলেন, সে তার বয়সের তুলনায় দ্রুত বেড়ে উঠেছিল। সে যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেল, আমার মনে হয়েছে আমার একটি অংশ হারিয়ে ফেলেছি, যা কখনোই ফিরে পাব না। 

ঠিক এক মাস আগে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে যখন নাজির মৃত্যু হয়, সেই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রিয় কাজ ফুটবল খেলছিল সে। ৩ নভেম্বরের সেই দিনটি অন্য সব দিনের মতোই স্বাভাবিক ছিল নাজির বাবা ৪৭ বছর বয়সী নিদাল আবদেল মতি আল-বাবার কাছে। 

“সকালে আমি বেথলেহেমে কাজ করতে গিয়েছিলাম এবং নাজি গিয়েছিল স্কুলে।

দুপুর ১২টার দিকে যখন আমি কাজ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম, নাজিকে তার স্কুলের পাশে দেখতে পেলার। সে-ও স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। আমার ট্রাকে করে একসঙ্গে বাড়ি ফিরলাম দুজনে।’ সেদিন দুপুরে নাজির প্রিয় খাবার ‘মুরগির সঙ্গে মোলোখিয়া’ রান্না করেছিল তার বোনেরা। পরে বাবাকে বলে বাড়ির পাশেই বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে যায় নাজি। ঘণ্টাখানেক পরে বাড়িতে এসেছিল নাজি। ৩টা নাগাদ আবারও খেলতে যায় সে। এটাই পরিবারের সঙ্গে তার শেষ দেখা। 

 

কিছু সময় পরেই সাড়ে তিনটার দিকে ‘চাচা নাদিল, চাচা নাদিল’ বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আসে নাজির চাচাতো ভাই। আতঙ্কিত পরিবারটি জানতে পারে নাজি যেখানে খেলছিল সেখানে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। নাজির গুলি লেগেছে। 

হঠাৎই দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেয় পরিবারটির জন্য। হয়তো অল্প আঘাত পেয়েছে— এমন আশা নিয়ে মরিয়া হয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় নাজির বাবা নিদাল ও চাচা সামির। 

তারা সেখানে দেখতে পান জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইসরায়েলি সেনারা। ছেলেকে ফেরত চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর চড়াও হয় সেনারা। নির্মমভাবে পিটিয়ে তার হাত ভেঙে দেয় তারা। ছেলেকে ফেরত চাইতে থাকলে ভাঙা হাতে হাতকড়া পরিয়ে ৪০ মিনিট ফেলে রাখে দখলদার সেনারা। 

সেদিনের স্মৃতি মনে করে নিদাল বলছিলেন, এটা তার জীবনের কঠিনতম ৪০ মিনিট। তিনি বলেন, আমি শুনতে পাচ্ছিলাম এক অফিসার সেনাদের দুটি দলে বিভক্ত হতে বলছিল। পাঁচজনকে ডানে আর মরদেহ তুলতে একজনকে বাঁয়ে দাঁড়াতে বলে। সেই সময় আমি চিৎকার করতে শুরু করলাম— ১৪ বছরের একটা ছেলেকে তোমরা কীভাবে হত্যা করতে পারো? সে তোমাদের কী ক্ষতি করেছিল? এক সেনা তখন আমাকে বলে, ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘নিষিদ্ধ’ এলাকায় প্রবেশ করেছিল নাজি। 

নিদাল বলেন, এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল— হয়তো এটা আমার ছেলে নয়, অন্য কেউ। সেনারা যখন মরদেহ নিয়ে যাচ্ছিল আমি দেখতে পেলাম এটা আমারই ছেলে নাজি। আমি দেখতে পেলাম তার পায়ে পরিহিত কালো জুতাটি, যেটি কয়েক দিন আগেই আমি কিনে দিয়েছিলাম। অনেক দিন ধরেই জুতাটি কিনে দেওয়ার বায়না ধরেছিল নাজি। আমার মনে আছে, যেদিন তাকে জুতাটি কিনে দিয়েছিলাম সে কতটা খুশি হয়েছিল। 

হতভাগ্য পরিবারটি জানতে পারে ঘটনার দুই ঘণ্টা পরে একটি ফিলিস্তিনি অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে নাজির মরদেহ হালহুলের আবু মাজেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ফরেনসিক রিপোর্টে দেখা যায়, নাজির শরীরে চারটি গুলি করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। একটি গুলি তার পেলভিসে, একটি গুলি পায়ে, একটি গুলি তার কাঁধে লাগে। চতুর্থ গুলিটি নাজির হৃৎপিণ্ড ভেদ করে গেছে। রিপোর্টে দেখা গেছে, গুলি করে ৩০ মিনিট চিকিৎসা ছাড়াই ফেলে রাখা হয়। 

পরের দিন নাজির মরদেহ পায় তার পরিবার। ভাঙা হাতে ছেলের মরদেহ কাঁধে নিয়ে শেষকৃত্য করেন নিদাল। জানাজায় যোগ দেয় হালহুলের হাজারো মানুষ। নাজি আল-বাবা হত্যার ঘটনায় মন্তব্য চেয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে আলজাজিরা। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ইসরায়েল। 

পরিবারের সব বিষয়ে যত্নবান ছিলেন নাজি। দাদির ওষুধ কখন লাগবে, ব্লাড প্রেশার ঠিক আছে কি না কিংবা শীতে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ সব কিছুতেই নজর থাকত নাজির। সবচেয়ে প্রিয় নাতিকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান দাদি ইন্তিসার আল-বাবা। খেলার মাঠে নাজিকে খুঁজে ফিরছেন তার বন্ধুরা। 

এই বিভাগের আরও খবর