বনগাঁ সীমান্ত থেকে বিশ্বজয়ের মঞ্চে
অন্যান্য খেলার মতো এজেন্ট কমিশন বলে অর্থকড়ির ব্যাপার ক্রিকেটেও আছে। কিন্তু নির্মাল্য সেন গুপ্তের কাছে আসা প্রস্তাবটি টাকা-পয়সার ছিল না। কলকাতা থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরের বনগাঁ সীমান্তের কাছাকাছি নিজের একটি একাডেমি চালাতে হিমশিম খাওয়া কোচকে বলা হয়, নির্দিষ্ট একজন খেলোয়াড়কে এনে দিতে পারলে বিনিময়মূল্য হিসেবে দেওয়া হবে একটি ঘাস কাটার মেশিন। এই মেশিনও তখন তাঁর কাছে কম অমূল্য নয়।
যে মাঠে খুদে ক্রিকেটারদের নিয়ে পড়ে থাকেন, ঘাস ছাঁটতে না পারায় মাঝেমধ্যেই সেখানে অনুশীলন চালানোটা মুশকিল হয়ে যায়। প্রস্তাবটি তিনি লুফে নিলেন তাই। কলকাতার ডালহৌসি ক্লাব থেকে ছুটিয়ে এনে তরুণ ফাস্ট বোলারকে দিয়ে যান টাউন ক্লাবের তাঁবুতে। এর পর থেকে একই সঙ্গে ঘটতে থাকল দুটো ব্যাপার।
বনগাঁর একাডেমির জন্য চেয়ে-চিন্তে নেওয়া মাঠে নিয়মিত ঘাস কাটার ব্যবস্থায় অনুশীলন যেমন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকল, তেমনি সেই পেসারও নীরব সংগ্রামের দিন পেরিয়ে নিজের সগৌরব আগমনীর বার্তাও দিতে শুরু করলেন।
বনগাঁ সীমান্তের ক্রিকেট কোচের স্নেহধন্য সেই বোলারই উত্থানের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে এখন আহমেদাবাদে বিশ্বজয়ের মঞ্চে এসে উপস্থিত। এর আগে মুম্বাইতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালকে ‘সামি-ফাইনাল’ বানিয়ে ফেলা মোহাম্মদ সামির ৫৭ রানে ৭ উইকেট নেওয়া পারফরম্যান্সের পরদিন সকাল থেকে নির্মাল্যের ফোনও ক্রমাগত বেজেই চলেছে। বিশ্বকাপ মাতিয়ে যেতে থাকা ফাস্ট বোলারের ক্রিকেট গুরুর কাছ থেকে তাঁর ফেলে আসা সংগ্রামমুখর জীবনের খোঁজও নিতে হবে যে!
একই উদ্দেশ্যে ফোনে ধরতেই ওপার থেকে নির্মাল্যের মৃদু আপত্তি, ‘আমাকে সামির কোচ না বললেই ভালো।
কোচিং-টোচিং আমি ওকে অত করাইনি। আমাকে বরং ওর আবিষ্কারকই বলতে পারেন।’ ক্রিকেটের পাঠ না দেওয়া ক্রিকেটারকে আবিষ্কারের মধ্যেই লুকিয়ে কষ্টকর এক জীবনের গল্পও। উত্তর প্রদেশের (ইউপি) মোরাদাবাদ থেকেও আরো প্রত্যন্তের আম্রোহারের হতাশাগ্রস্ত তরুণকে নিয়তি টেনে আনে বাংলায়।
আসার আগে অপু নামেই বেশি পরিচিত নির্মাল্যের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরিয়ে দেন ইউপির এক কোচ, ‘‘ইউপিতে আঞ্চলিক অনূর্ধ্ব-১৯ দলের একটি ট্রায়াল হয়েছিল।
সেটিতে সামি সুযোগ পায়নি। এরপর ওর কোচ বদরউদ্দিন আমাকে ফোন করে বলেন, ‘দাদা, এই ছেলেটি সুযোগ পাচ্ছে না। দেখো না কিছু করা যায় কি না।’ তখন আমি ওকে কলকাতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি।’’
কলকাতায় এলেও ক্লাবের ব্যবস্থা আর হয়ে ওঠে না। এখানে পাঠান, সেখানে পাঠান, কিন্তু কোনো ক্লাব সামিকে নিতেই চায় না। ত্রিপুরার একটি ক্লাবে খেলার ব্যবস্থা হলেও কিছুদিন পর জানিয়ে দেওয়া হয় যে সামিকে তাদের পছন্দ হয়নি। সামিকে কলকাতায় ফিরিয়ে এনে তাই আবার তাঁকে নিয়ে ক্লাবে ক্লাবে ঘোরার শুরু নির্মাল্যের।
কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে শরণাপন্ন হন বন্ধু শ্রীমন্ত হাজরার। ডালহৌসি ক্লাবের এই কর্মকর্তার কাছে গিয়েই অবশেষে কাজ হয়, ‘‘বন্ধুকে গিয়ে বললাম, ‘ছেলেটাকে খেলাও। ভালো খেলে।’ প্রথমে না করে দেয়। পরে শর্ত দিয়ে বলে, ‘ঠিক আছে খেলুক। প্রথম থেকেই যদি ভালো খেলতে পারে, তাহলে রাখব।’ ওই প্রথম সামি কলকাতার ক্লাবে সই করে।’’
নামমাত্র সম্মানীতে খেলার সঙ্গে ক্লাবেই হয় থাকার বন্দোবস্তও। উত্তর প্রদেশেই এখন ৬০ একর জায়গাজুড়ে বিশাল এক বিলাসবহুল বাগানবাড়ির মালিক সামিকে কিনা সেই সময় গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে অনেকের সঙ্গে। কাদের সঙ্গে শুনবেন? নির্মাল্যের মুখে সেই গল্পটিও শুনুন, ‘আমার বাসা তো বনগাঁয়। ওই বাসাতেই ৯ বছর থেকে মানুষ হয়েছে অভিমন্যু ঈশ্বরণ। একদম আমার ছেলের মতোই। সামিও মাঝেমধ্যেই আমার বাসায় বেড়াতে আসত। কিন্তু ক্লাব ক্রিকেট খেলার জন্য ওকে কলকাতায়ই থাকতে হতো। ডালহৌসিতে ওর থাকার ব্যবস্থা হয় ক্লাবের মালিদের ঘুপচি ঘরে।’
অন্ধকার পেরিয়ে তাঁর আলোর দেখা পাওয়ার শুরুও সেখান থেকেই, ‘ডালহৌসি ক্লাবে শুরু থেকেই পারফরম করতে শুরু করে সামি। সুবাদে চাহিদাও বাড়তে থাকে। এরপর আর ওকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধাপে ধাপে এগোতে থাকে। এক পর্যায়ে বাংলার হয়ে রঞ্জি খেলতে খেলতে জাতীয় নির্বাচকদের নজর কেড়ে চলে আসে ভারতীয় দলেও।’
ডালহৌসি ক্লাব থেকে শুরু হওয়া সামির উত্থানের গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে বিনিময়মূল্য হিসেবে পাওয়া নির্মাল্যের সেই ঘাস কাটার মেশিনও!