একসঙ্গে এতজন টিভি উপস্থাপককে বয়কট কেন করল ‘ইন্ডিয়া’?
-1694838044.jpg)
ভারতের বিরোধীদলীয় জোট ‘ইন্ডিয়া’ জানিয়েছে, তারা জাতীয় টেলিভিশনের ১৪ জন উপস্থাপকের অনুষ্ঠান এখন থেকে বয়কট করবে। কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী একসঙ্গে এতজন সংবাদ উপস্থাপকের অনুষ্ঠান বয়কট করছে এবং সেই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানাচ্ছে—এমন ঘটনা ভারতে বিরল।
‘ইন্ডিয়া’ জোট বলছে, ওই ১৪ জন উপস্থাপক তাদের সংবাদভিত্তিক বিতর্ক অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আসলে ‘ঘৃণা’ ছড়ান। যেসব উপস্থাপককে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট, তাদের সাধারণভাবে ‘গদি মিডিয়া’ বলে চিহ্নিত করে বিরোধীদলগুলো।
কারণ তারা মনে করে, ওইসব উপস্থাপকরা ও তাদের চ্যানেলগুলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমর্থক।
বিজেপি ও সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো বিরোধী জোটের এ ধরনের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। যেসব উপস্থাপকদের বয়কট করার কথা জানিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট, তাদের অনেকেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘোষণার প্রতিবাদ করছেন।
আবার কয়েকজন উপস্থাপক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নাম উল্লেখ না করার শর্তে এটা স্বীকার করছেন, ওই ১৪ জন সংবাদ উপস্থাপকদের অনুষ্ঠানগুলো দেখলে মনে হয়, তারা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ নিয়েই কথা বলেন এবং বিরোধীদলের প্রতিনিধিদের হেনস্থা করার জন্যই যেন ডাকা হয়।
তা সত্ত্বেও এভাবে আনুষ্ঠানিক বয়কট করা কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষেই অনুচিত এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ।
কেন উপস্থাপকদের বয়কট?
‘ইন্ডিয়া’ জোটের পক্ষ থেকে ১৪ জন উপস্থাপকের অনুষ্ঠান বয়কট করার কথা ঘোষণা করে কংগ্রেস নেতা পবন খেরা বলেন, ‘প্রতি সন্ধ্যায় ৫টা বাজলেই কয়েকটি চ্যানেলে ঘৃণা ছড়ানোর বাজার বসে যায়। ৯ বছর ধরে এটাই চলছে। বিভিন্ন দলের কয়েকজন মুখপাত্র ওই বাজারে যান, কয়েকজন বিশেষজ্ঞ, কয়েকজন বিশ্লেষক থাকেন...কিন্তু সত্যটা হলো, আমরা সবাই ওই ঘৃণার বাজারের ক্রেতা হয়ে হাজির হই।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এই ঘৃণার ন্যারেটিভ চালানোর অনুমোদন দিতে পারি না। এই ন্যারেটিভ সমাজকে দুর্বল করছে। আপনি যদি সমাজে ঘৃণা ছড়ান, সেটা হিংসায় পরিণত হয়। আমরা এর অংশ হব না।’
কড়া প্রতিক্রিয়া
ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোর সংগঠন নিউজ ব্রডকাস্টার্স অ্যান্ড ডিজিটাল অ্যাসোসিয়েশন এনবিডিএর সভাপতি ও এবিপি নেটওয়ার্কের মুখ্য কার্যনির্বাহী অবিনাশ পাণ্ডে বলছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত সংবাদমাধ্যমের গলা টিপে ধরার মতো।
যে জোট গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে, দেখা যাচ্ছে তারাই তো সেগুলো ধ্বংস করছে। তবে আমরা সব অনুষ্ঠানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাবো।’
‘ইন্ডিয়া’ জোটের এই সিদ্ধান্ত একটি বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি করছে বলেও মন্তব্য করেছে এনবিডিএ। তারা বলছে, বিরোধী জোট ‘নিজেদের বহুত্ববাদ এবং মুক্ত সংবাদপত্রের সমর্থক হিসেবে বর্ণনা করে। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিকেই আঘাত করে’।
যেসব উপস্থাপকদের বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট, তাদের মধ্যে রয়েছেন ‘আজতক’ চ্যানেলের জনপ্রিয় উপস্থাপক সুধীর চৌধুরী। এই তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (টুইটার) লিখেছেন, ‘ইন্ডিয়া জোটের সামনে যে সাংবাদিক ও উপস্থাপকরা নির্ভয়ে মোকাবেলা করেছেন, যারা পায়ে চুম্বন করতে অস্বীকার করেছেন, এখন তাদের বয়কট করা হবে। প্রায় অর্ধেক ভারতে এই জোটের সরকার রয়েছে। যখন লোভ, পুরস্কার আর এফআইআর করেও কাজ হলো না তখন বয়কট। এখন সর্বশক্তি দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর জবাব দেওয়া উচিত ভারতের সংবাদমাধ্যমের। এটা খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি।’
বয়কটের তালিকায় থাকা আরো একাধিক উপস্থাপকও একই সুরে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অর্ণব গোস্বামী, অমিশ দেভগন ও নাভিকা কুমারের মতো উপস্থাপক, যাদের নামও রয়েছে ওই তালিকায়, তারা নিজের সংবাদ অনুষ্ঠানে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করেছেন।
তারা অবশ্য কেউ পৃথকভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি। কিন্তু নাম উল্লেখ না করার শর্তে কলকাতার একটি বাংলা চ্যানেলের এক জ্যেষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপক বলেছেন, ‘এটা ঠিকই যে জাতীয় স্তরের টিভি চ্যানেলের কয়েকজন এমনভাবে সংবাদ উপস্থাপন করেন বা সান্ধ্য বিতর্ক পরিচালনা করেন, যাতে মনেই হয় যে তারা একটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে অনুষ্ঠান করতে এসেছেন। ওই সব অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই এমনভাবে কথা বলা হয়, যেন বিরোধীদলের মুখপাত্ররা কোনো অপরাধী।’
তিনি আরো বলেন, ‘তবে এটাও ঠিক, সব রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীরই সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। যতই প্রতিকুল পরিস্থিতি তৈরি হোক কোনো টিভি বিতর্ক অনুষ্ঠানে, সেটা তো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে একটা মঞ্চ, সেখানে তো তারা জোর গলায় তারা নিজেদের বক্তব্য দিতেই পারে।’
‘নাৎসিদের মতো কাজ’
এদিকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের এই বয়কট তালিকায় কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিজেপি। দলের সভাপতি জেপি নাড্ডা ‘ইন্ডিয়া’ জোটের এই সিদ্ধান্তকে নাৎসিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংবাদ উপস্থাপকদের এ রকম একটা তালিকা প্রকাশ নাৎসিদের মতো কাজ, যেখানে ঠিক করা হয় যে কাদের নিশানা করা হবে। এসব দলগুলোর মধ্যে এখনো জরুরি অবস্থার মানসিকতা কাজ করছে।’
বিজেপির এক সময়ের সহযোগী দল ও বর্তমানে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অংশ শিবসেনার (উদ্ভব ঠাকরে গোষ্ঠী) নেত্রী প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, আদানি গোষ্ঠী এনডিটিভি অধিগ্রহণ করার আগে পর্যন্ত বিজেপিও তো ওই চ্যানেলটিকে বয়কট করত।
সাত বছর বয়কট সহ্য করেছি : রভিশ কুমার
এনডিটিভির সাবেক উপস্থাপক রভিশ কুমার এক্সে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্তব্য করে লিখেছেন, ‘সাত বছর বয়কট সহ্য করেছি। এমনকি সাত ঘণ্টাও তো হয়নি। মনে হচ্ছে আগামীকালই প্রধানমন্ত্রী প্রথমবার সংবাদ সম্মেলন করেই ফেলবেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য। যেখানে এসব মানুষরাই প্রশ্ন তুলবেন। তারপর এরাই সানা ইরশাদ মাট্টুর কাছে এর জন্য ক্ষমা চাইতে যাবেন।’
মন্তব্যের সঙ্গে রভিশ কুমার বিবিসি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি খবরের স্ক্রিনশট দিয়েছেন, যার শিরোনাম ছিল ‘পুলিৎজার বিজয়ী কাশ্মীরি সাংবাদিক সানা ইরশাদ মাট্টুকে ভারত ছাড়তে বাধা’।