img

নারায়ণগঞ্জ চান্দিনার বাসিন্দা শাহেদা আক্তার (২৬)। ডেঙ্গু আক্রান্ত এই নারীর রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে ২৪ হাজারে নেমেছে। শাহেদার ভাই রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গতকাল প্লাটিলেট ছিল আড়াই লাখ, আজ সকালে নতুন করে পরীক্ষার পর দেখা গেছে ২৪ হাজারে নেমে এসেছে। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।তাই এখানে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা করাচ্ছি। ’

গতকাল রবিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কথা হয় রফিকুলের সঙ্গে। শুধু রফিকুলের বোন শাহেদা নন, এই হাসপাতালে তাঁর মতো অনেকে ডেঙ্গু রোগীই শয্যা না পেয়ে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে। 

kalerkanthoগতকাল রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালেও শয্যা না পেয়ে ডেঙ্গু রোগীদের মেঝেতে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। আর ঢাকা শিশু হাসপাতালে মেঝেতে রোগী না থাকলেও ডেঙ্গু ওয়ার্ডে শয্যা খালি নেই। এই হাসপাতালে নির্ধারিত শয্যার বাইরে রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াতে হচ্ছে স্বজনদের। 

তিন হাসপাতালে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোগীদের ৯০ শতাংশই জ্বর নিয়ে আসছে। বেশির ভাগ রোগীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। শয্যা না পেয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে রোগীর শারীরিক অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। 

মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি ভোলার নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘এলাকায় চিকিৎসা ভালো হলে তো এইখানে পাঠাইতো না। তিন দিন ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। ’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, শয্যার চেয়ে রোগী বেশি; কিন্তু ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নতুন আলাদা ইউনিট এখন নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখন সব জায়গায় ডেঙ্গু রোগীদের রাখা হচ্ছে। বর্তমানে ভর্তি রোগী আছে ১৬৩ জন। গত এক সপ্তাহে শুধু ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়ে ২৫৭ জন। তিনি বলেন, ‘আমার এখানে যত রোগী আসে তার বেশির ভাগই গুরুতর অবস্থার। কাউকে ফেরত দিচ্ছি না। মেঝেতে হোক আর সিঁড়িতে হোক—চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। ’

ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর জন্য শয্যা আছে ৪০টি। এর বিপরীতে গতকাল ভর্তি ছিল ৭৭ জন। গত এক সপ্তাহে এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছে ১১০ জন। এসব তথ্য জানিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বেশ কয়েকজন রোগীকে আইসিইউ, সিসিইউতে রাখা হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য কিডনি রোগীর আইসিইউও ব্যবহার করছি। ’ তিনি বলেন, শয্যা ফাঁকা না থাকায় বেশির ভাগ রোগীকে চিকিৎসাপত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠাতে হচ্ছে। এদের অনেককেই হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন ছিল। 

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশিদ উন নবী বলেন, শুধু শিশুদের জন্য তিন ইউনিট মিলিয়ে ১৫টি শয্যা আছে। বয়স্কদের মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে ভর্তি হয়েছে ১১০ জন। যাদের বেশির ভাগেই শয্যার বাইরে মেঝেতে রাখতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দেখা যায়, শয্যা ফাঁকা হয়েছে একটা। আর রোগী আসে আট থেকে ১০ জন। এত রোগী আমি কোথায় জায়গা দেব? এর মধ্যে ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসছে। ’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রবিবার সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৮৫৫ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ বছর এক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড এটি। নতুন রোগীদের নিয়ে ঢাকার ৫১টি হাসপাতালে মোট ভর্তি আছে এক হাজার ৯৫৭ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় এসব হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ৫২৩ জন। এ নিয়ে চলতি বছর এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ২৫ হাজার ১৮১ জন। মৃত্যু হয়েছে ৯৪ জনের। 

এর আগে গত বছরে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ২৩ হাজার ৬৫৫ জন। আর মৃত্যু হয় ৯১ জনের। এই বছরে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় ২৮ হাজার ৪১৯ জন। মারা যায় ১০৫ জন। ২০২০ সালে আক্রান্ত রোগী এক হাজার ৪০৫ জন। মৃত্যু হয় সাতজনের। ২০১৯ সালে আক্রান্ত রোগী ছিল সবচেয়ে বেশি এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। 

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, আক্রান্ত রোগীদের সবার তথ্য সরকারের নজরদারির মধ্যে আসে না। অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়ে পরীক্ষা করছে না। আবার অনেকে নির্ধারিত সময়ের পর করছে। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। 

গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ব্রিফিংয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বলছেন, ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে ডেন-ওয়ান ও ডেন-টু সেরোটাইপ ডেঙ্গু উপস্থিতি ছিল। এরপর ২০২১ ডেন-থ্রি ছিল। এবার ঢাকার ডেন-ফোরের উপস্থিত পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে কক্সবাজারে একাধিক সেরোটাইপ ডেন-ওয়ান, ডেন-টু, ডেন-থ্রি ও ডেন ফোর সেরোটাইপ ডেঙ্গু হচ্ছে। ফলে সেখানে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি। 

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শাখার ডেপুটি প্রগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. ইকরামুল হক জানান, চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৩৮ শতাংশ শিশু। যাদের বয়স এক থেকে ১৮ বছর। ২০ বছরের বেশি আক্রান্ত হয়েছে ৬২ শতাংশ। তিনি বলেন, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৩৫ শতাংশ শিশু। ২১ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছর। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে মারা গেছে ৬৪ শতাংশ। 

গত শনিবার পর্যন্ত ১৫ হাজার ৭৬৪ রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুরে ১৫৮০, উত্তরায় ১৪২৬, মুগদায় ৭৮০ জন, কেরানীগঞ্জ ৬৬৯, যাত্রবাড়ী ৬০২, ধানমণ্ডির ৫৮৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে কক্সবাজার এলাকায় রোগী এক হাজারের বেশি। 

কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, এর আগে অক্টোবরে এত ডেঙ্গু আক্রান্ত ছিল না। এবার জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের মৌসুম পরির্বতন হয়েছে। যখন ডেঙ্গু বাড়তে থাকে, তখন সেটি থামানো না গেলে জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি হটস্পট ম্যানেজমেন্ট করতে না পারি চলতি মাসে কমবে বলে মনে হচ্ছে না। অর্থাৎ হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে রোগীর এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কোথায় মশার লার্ভা বেশি সেটা বড় কথা নয়, কারণ আগে ডেঙ্গু রোগী সংখ্যা ঠেকাতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর