img

অমুসলিম দেশে মুসলিমদের বসবাস ও নাগরিকত্ব গ্রহণ করার বিধান নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের অবস্থা এবং ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি তাদের মনোভাব ও অবস্থান বিবেচনায়। অমুসলিম দেশগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। 

১. যেখানে ধর্মবিদ্বেষ প্রবল : যেসব দেশে সাধারণভাবেই ধর্মবিদ্বেষ প্রবল। বিশেষত যেসব দেশের মানুষ ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে, ইসলামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সন্ত্রাস বলে এবং যেসব দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামবিদ্বেষ উসকে দেয়, সেসব দেশের স্থানীয় মুসলিমরা সেখানে ধৈর্যসহ বসবাস করবে এবং দ্বিনের ব্যাপারে যেন শীথিলতা চলে না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখবে।তাদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের অবকাশ হলো, ‘কিন্তু কেউ অবাধ্য বা সীমালঙ্ঘনকারী না হয়ে অনন্যোপায় হলে আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১১৫)

তবে কোনো মুসলিম দেশ থেকে এমন দেশে হিজরত (দেশান্তর) করা বৈধ নয়। কেননা যেখানে ইসলাম দ্বিন পালনের সুযোগ না থাকলে মাতৃভূমি ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে, সেখানে এমন পরিবেশে যাওয়া কিছুতেই বৈধ হবে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা নিজেদের ওপর অবিচার করে তাদের প্রাণ গ্রহণের সময় ফেরেশতারা বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, পৃথিবীতে আমরা অসহায় ছিলাম। তারা বলে, আল্লাহর জমিন কি এমন প্রশস্ত ছিল না, যেখানে তোমরা হিজরত করতে? তাদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম, আর তা কত মন্দ আবাস। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৯৭)

২. পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে : যেসব দেশে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও চিন্তার স্বাধীনতা আছে এবং যেখানে বিশেষ একটি ধর্মের অনুসারীরা অন্যদের প্রভাবিত ও পদানত করতে সচেষ্ট নয়; বিশেষত যেখানে ধর্মের প্রশ্নে রাষ্ট্রের অবস্থান নিরপেক্ষ এমন দেশে বৈধ উদ্দেশে যাওয়া এবং অবস্থান করা বৈধ। যেমন চাকরি, লেখাপড়া ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ জানেন যে তোমাদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশভ্রমণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে সংগ্রামে লিপ্ত হবে। ’ (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ২০)

তবে এমন দেশে অবস্থানের ক্ষেত্রেও শর্ত হলো নিজের, পরিবারের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দ্বিনদারির ব্যাপারে আশঙ্কা না থাকা এবং বস্তুবাদী দর্শনের প্রভাবে ঈমান ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসে দুর্বলতা তৈরি না হওয়া। যদি সেখানে যাওয়ার পর এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তবে তা পরিত্যাগ করতে হবে। জীবন সেখানে যতই প্রাচুর্যময় হোক না কেন। কেননা আল্লাহ বলেন, ‘বোলো, তোমাদের কাছে যদি আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার অপেক্ষা প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা করো এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কোরো আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। ’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ২৪)

নাগরিকত্ব গ্রহণের বিধান : কোনো মুসলমানের জন্য অমুসলিম দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা বৈধ কি না—এ বিষয়ে সমকালীন আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। তাদের মধ্যে আল্লামা মোস্তফা আল-ঝারকা, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ ও মান্না আল-কাত্তান প্রমুখ আলেম মুসলমানের জন্য অমুসলিম দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণকে হারাম বলেছেন। মিসরের বিখ্যাত আলেম ও ধর্মতাত্ত্বিক হাসান আল-বান্না বিষয়টিকে ‘আকবারুল কাবায়ির’ (জঘণ্যতম কবিরা গুনাহ) বলেছেন। তাদের দলিল হলো মহান আল্লাহর বাণী—‘মুমিনরা যেন মুমিনরা ছাড়া অবিশ্বাসীদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে ব্যক্তি এরূপ করবে তার সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ২৮)

যেসব শর্তে নাগরিকত্ব গ্রহণ করা যাবে : লেখক (ড. ইউসুফ আল-কারজাভি)সহ বহু আলেম মনে করেন, অমুসলিম দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের বিষয়টি শর্তসাপেক্ষ। যদি অমুসলিম দেশের পরিবেশ ঈমান ও ইসলামের জন্য বৈরী না হয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঈমান রক্ষার ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়া যায়, তবে অমুসলিম দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের অবকাশ আছে। কেননা বিরূপ মনোভাব পোষণ করে না এমন অমুসলিমদের ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা হলো, ‘দ্বিনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেননি। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। ’ (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)

এ ছাড়া অমুসলিম দেশের মুসলমানের নাগরিকত্ব গ্রহণের ইতিবাচক প্রভাবও আছে। কেননা তা অমুসলিম দেশে ‘উজুদু ইসলামী’ তথা ইসলামের অস্তিত্বকে দৃঢ় করে এবং ইসলাম প্রচারের সুযোগ বৃদ্ধি করে। মুসলমানের অবস্থানের ফলে সেসব দেশে মাদরাসা-মসজিদের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। যা স্থানীয়দের ইসলাম সম্পর্কে জানতে উদ্বুদ্ধ করে এবং ইসলাম গ্রহণের সুযোগ করে দেয়। বিপরীতে ইসলাম ও মুসলমানের অনস্তিত্ব ইসলাম প্রসারের পথরুদ্ধ করে। যা বৈশ্বিক ধর্ম ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। 

অমুসলিম দেশে যেভাবে বসবাস করবে : মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হওয়ার পরও জাফর ইবনে আবি তালিব (রা.) সপ্তম হিজরিতে খায়বার বিজয়ের আগ পর্যন্ত একজন অমুসলিম কর্তৃক শাসিত অমুসলিম দেশ হাবশায় অবস্থান করেন। এতে প্রমাণিত হয়, দ্বিন প্রচারের স্বার্থে মুসলিম দেশে বসবাস করা বৈধ। পবিত্র কোরআনেও দ্বিন প্রচারের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘হে রাসুল, আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দিন। যদি আপনি তা পৌঁছে না দেন, তবে আপনি তাঁর বাণী প্রচার করলেন না। ’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৬৭)

প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, অমুসলিম দেশে মুসলমানের অবস্থান দ্বিনের জন্য কল্যাণকর তখনই হবে, যখন সে তার যাপিত জীবনে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করবে এবং তার পরিবারকে দ্বিনের বিধান অনুসারে পরিচালনা করবে। যেন তার সমগ্র জীবনেই দ্বিন প্রস্ফুটিত হয়। 

নবীজি (সা.)-এর সতর্কবার্তা : অমুসলিম দেশে বসবাসের ব্যাপারে নবীজি (সা.) সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আমি সেসব মুসলিম থেকে দায়মুক্ত, যারা মুশরিকদের মধ্যে বসবাস করে। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ২৬৪৫)

তিনি আরো বলেছেন, ‘কেউ কোনো মুশরিকদের সাহচর্যে থাকলে এবং তাদের সঙ্গে বসবাস করলে সে তাদেরই মতো। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ২৭৮৭)

উল্লিখিত হাদিসের ভিত্তিতে মুহাদ্দিসরা বলেন, মুসলিমরা অমুসলিম দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ ও সেখানে বসবাসের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবে। বিশেষত যখন তার ঈমান ও ইসলাম হুমকির মধ্যে পড়ার ভয় থাকে। 

লেখকের দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘ফিকহুল আইশিল মুশতারাকিল মুওয়াতানাতি নামুজাঝান’-এর নির্বাচিত অংশ ভাষান্তর করেছেন

আতাউর রহমান খসরু

এই বিভাগের আরও খবর