রাতের ঘুমও কেড়ে নিচ্ছে লোড শেডিং
রাজধানীসহ সারা দেশেই সকাল আর দুপুর তো বটেই, মধ্যরাতেও লোড শেডিংয়ের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ভোগান্তি হচ্ছে বেশি। রাজধানীতে দিনরাত মিলিয়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না।ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি আরো খারাপ। কোনো কোনো জেলা ও গ্রামাঞ্চলে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাচ্ছে না মানুষ।
এই পরিস্থিতি কবে ঠিক হবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না কেউ। যদিও গতকাল সোমবার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘নভেম্বরের আগে লোড শেডিং পরিস্থিতির উন্নতির আশা নেই। ’ যদিও গত ১৪ আগস্ট বিদ্যুৎ ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে দেশে আর লোড শেডিং থাকবে না। ’
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ গতকাল আশার বাণী শুনিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চল গ্রিডে এক হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকছে। ঘোড়াশাল উপকেন্দ্রের যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে আগামীকালের (মঙ্গলবার) মধ্যে তা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা সম্ভব হবে। এতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে।
রাজধানীর মিরপুর-১-এর কলওয়ালাপাড়া বহুবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত মঙ্গলবার গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনার পর থেকেই লোড শেডিং বেড়ে গেছে। প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে, দুপুর ২টার দিকে, সন্ধ্যার দিকে, মধ্যরাত ১২টা-১টার দিকে আবার ভোর ৩টা-৪টার দিকে নিয়মিত লোড শেডিং হচ্ছে। আমাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। মধ্যরাতে একাধিকবার লোড শেডিংয়ের কারণে প্রায় নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে। ’
প্রায় একই অভিজ্ঞতা রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সেলিনা রহমানের। তিনি বলেন, ‘গত রাত (রবিবার দিবাগত রাত) ২টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। গরমে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুমাতে পারিনি। ঘুম না হওয়ায় সকালে বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাতেও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এরপর সকালে আবার ১১টার দিকে এক ঘণ্টার লোড শেডিং হয়। পরে আবার দুপুর ২টায় বিদ্যুৎ চলে যায়। ভোগান্তির যেন শেষ নেই। ’
ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী দুই প্রতিষ্ঠানের একটি ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জ্বালানিসংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়ায় আমরা এখন বরাদ্দের চেয়ে কম পাচ্ছি। যার কারণে লোড শেডিং বেশি দিতে হচ্ছে। গ্রাহকদের কষ্ট হচ্ছে, আমরা বিষয়টি বুঝতে পারছি, তার পরও আমাদের কিছু করার নেই। তবে আশা করছি, খুব দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ’ তিনি বলেন, ‘আজ (গতকাল) আমাদের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল এক হাজার ৬৭ মেগাওয়াট। বিপরীতে পেয়েছি মাত্র ৭৭২ মেগাওয়াট। বাকিটা লোড শেডিং দিতে হয়েছে। ’
এদিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে গ্রাহকদের। গ্রাহকরা বলছে, দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে।
কুলাউড়া ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা মেনে রাত ৮টায় দোকানপাট বন্ধ করতে হচ্ছে। সকালে দোকান খোলার পর দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। আগে পৌর শহরে কম লোড শেডিং হতো। বর্তমানে সাত-আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ’
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কুলাউড়া সাবজোনাল অফিসের এজিএম নাজমুল হক তারেক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের চাহিদা প্রতিদিন আট মেগাওয়াটের বেশি, পাচ্ছি দু-তিন মেগাওয়াট। ’
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার সলিমপুরের বাসিন্দা সুময়াই সাদমিন বলেন, দিনে-রাতে আট থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। গরমের মধ্যে কাজকর্মে নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরেও বিদ্যুৎ পরিস্থিতির একই অবস্থা। স্থানীয় ব্যবসায়ী হান্নান আহমেদ বলেন, সন্ধ্যার পর দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ থাকে না। তাই দোকান খোলা সম্ভব হয় না। এ কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা।
কমছে না লোড শেডিং
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল সচিবালয়ে বলেন, ‘লোডের কারণে আমরা দিনের বেলা কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখছি। আবার দিনে যেগুলো চালাচ্ছি সেগুলো রাতে বন্ধ রাখছি। এ জন্য লোড শেডিংয়ের জায়গাটা একটু বড় হয়ে গেছে। আমরা চেয়েছিলাম অক্টোবর থেকে কোনো লোড শেডিংই থাকবে না, কিন্তু সেটা আমরা করতে পারলাম না। কারণ আমরা গ্যাস আনতে পারিনি। ’ তিনি আরো বলেন, ‘সমস্যাটা সাময়িক হতে পারে। তবে আমি মনে করি, বললেই এটা সাময়িক হচ্ছে না। কারণ বিশ্ব পরিস্থিতি আবার অন্য রকম করে ফেলে। এই মাসটা (অক্টোবর) একটু কষ্ট করতে হবে। আশা করছি, সামনের মাস থেকে আরেকটু ভালো হবে। ’ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন শিল্প-কারখানায় গ্যাস দেওয়া হচ্ছে বলে জানান নসরুল হামিদ।
সোমবার ঘাটতি ১,৫১৪ মেগাওয়াট
দেশে গতকাল বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি ছিল এক হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) পরিচালক (জনসংযোগ) শামীম হাসান কালের কণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, আজ (গতকাল) দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৬৮৬ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল এক হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। তিনি আরো বলেন, বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে, যার কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি বাড়ছে।
বন্ধ ৩০ বিদ্যুৎকেন্দ্র
গ্যাস ও জ্বালানি তেল সংকটে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। যার কারণে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমে বিদ্যুতের ঘাটতি বাড়ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে উৎপাদন বন্ধ ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের। ফলে চাহিদার বিপরীতে দেড় হাজারের বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হচ্ছে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘গ্যাসের অভাবে আমাদের কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে কম লোডে চলছে, আবার কিছু বন্ধও রয়েছে। তাই এ লোড শেডিং দিতে হচ্ছে। ’