img

আল্লাহ তাআলা মানুষকে বিভিন্ন প্রকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের স্বভাবকে অভিন্ন করে সৃষ্টি করেননি। একেক বিষয়ে একেকজন পারদর্শী। পৃথিবীর সব বিষয়ে একজন পারদর্শী—এমন কোনো মানুষ দুনিয়াতে নেই।সে জন্য আমাদের কোনো কাজ করার প্রয়োজন হলে আমরা সে ব্যাপারে অভিজ্ঞদের শরাণপন্ন হতে হয়। এর মাধ্যমে আমাদের সামনে উত্তম পথ উন্মোচিত হয়। কখনো আমাদের আমরা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, আমাদের করণীয় কী, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকি, কোনটা রেখে কোনটা গ্রহণ করব, সে বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে পরামর্শ। আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রিয় নবীকে পরামর্শের আদেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা (মুসলমানরা) পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে। ’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ৩৮)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং (গুরুত্বপূর্ণ) বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। অতঃপর তুমি যখন (কোনো বিষয়ে) মনস্থির করবে, তখন আল্লাহর ওপর নির্ভর করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন। ’ (সুরা : আল-ইমরান, আয়াত : ১৫৯)

রাসুল (সা.) সবচেয়ে বেশি পরামর্শ করতেন

পরামর্শ এত অত্যধিক গুরুত্বের কারণে প্রিয় নবী (সা.) সবচেয়ে বেশি পরামর্শ করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে বেশি পরামর্শকারী অন্য কাউকে দেখিনি। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৪৮৭২)

রাসুল (সা.) যেখানে এত বেশি পরামর্শের গুরুত্ব দিতেন, সেখানে আমরা তো এর প্রতি আরো বেশি এর মুখাপেক্ষী। 

ব্যক্তিগত বিষয়ে পরামর্শ

আমরা ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে হিমশিম খেতে হয়। তখন সে বিষয়ে পরামর্শ করলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়। সে জন্য রাসুল (সা.) ব্যক্তিগত জীবনেও পরামর্শ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। ফাতেমা বিনতে কাইস (রা.) বলেন, একদা আমি নবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলাম যে মুআবিয়া ইবনে আবু সুফয়ান (রা.) ও আবু জাহম (রা.) আমাকে বিবাহের পায়গাম পাঠিয়েছেন। (এ ক্ষেত্রে আমি কী করব?) রাসুল (সা.) বললেন, আবু জাহম এমন লোক যে তার কাঁধ থেকে লাঠি নামায় না। আর মুআবিয়া তো নিঃসম্বল, গরিব মানুষ। বরং তুমি ওসামা ইবনে জায়েদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হও। কিন্তু আমি তাঁকে পছন্দ করলাম না। পরে তিনি আবার বললেন, তুমি ওসামাকে বিয়ে করো। কিন্তু আমি তাঁকে পছন্দ করলাম না। তিনি আবার বললেন, তুমি ওসামাকে বিয়ে করো। তখন আমি তাঁর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। আর আল্লাহ এতে (তার ঘরে) আমাকে বিরাট কল্যাণ দান করলেন। আর আমি ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হলাম। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৫৮৯) 

রাষ্ট্রীয় বিষয়ে পরামর্শ

নবী (সা.) রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। হাদিসের কিতাবে এসংক্রান্ত অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে, ওহুদের যুদ্ধের সময়, হুদাইবিয়াসহ বিভিন্ন যুদ্ধে রাসুল (সা.) সাহাবাদের সঙ্গে গুরুত্বসহ পরামর্শ করেছেন। আর সাহাবায়ে কেরাম প্রত্যেকেই নিজের মতামত রাসুলের সামনে পেশ করেছেন। 

কার সঙ্গে পরামর্শ করব

যেকোনো বিষয়ে যে কারো সঙ্গে পরামর্শ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, আমি যে বিষয়ে পরামর্শ করব তা এমন ব্যক্তির সঙ্গে হওয়া চাই, যে সে বিষয়ে অভিজ্ঞ। যদি তার সে বিষয়ে কোনো জ্ঞানই না থাকে, তাহলে তার সঙ্গে পরামর্শ করে কোনো উপকার আসবে না। সে জন্য যার সঙ্গে পরামর্শ করব তার ব্যাপারে ভালোভাবে অবগত হওয়া। ইলেমহীন বেদ্বিন লোকদের সঙ্গে পরামর্শের মাঝে সুফলের চেয়ে কুফল বেশি। 

বড়-ছোট সবার সঙ্গে পরামর্শ করা

অনেকের ধারণা, পরামর্শ শুধু বড়দের সঙ্গেই করা হয় বা তাদের সঙ্গেই করা জরুরি। এ ধারণা ঠিক নয়; বরং বড়দের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। তাদের অবর্তমানে নিজের সমবয়সী বা ছোটদের সঙ্গেও পরামর্শ করতে সমস্যা নেই। আমাদের নবী সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ছিলেন। তবু আল্লাহ তাআলা তাঁকে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় পরামর্শের ক্ষেত্রে বড়রা কোনোভাবেই অমুক্ষাপেক্ষী নয়। তাঁদেরও ছোটদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। 

কোন বিষয়ে পরামর্শ করব

যেসব বিষয় শরিয়তে অকাট্যভাবে নির্দেশ দিয়েছে, সেসব বিষয়ে পরামর্শ করার সুযোগ নেই। কারণ এসব বিষয়ে আল্লাহ আমাদের ওপর অবধারিত করে দিয়েছেন। তাই এ ক্ষেত্রে পরামর্শ করা অবান্তর। বরং পরামর্শ এমন বিষয় হবে, যে বিষয়গুলো নিয়ে আমি দ্বন্দ্বে আছি কোনটা আমার জন্য কল্যাণকর হবে। 

যিনি পরামর্শ দেবেন

আমার কাছে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো বিষয়ে পরামর্শ চায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে আমাকে অবশ্যই তাকে উত্তম পরামর্শ দিতে হবে। যদি সে বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা আর তেমন জানাশোনা না থাকে, তাহলে তাকে কোনো পরামর্শ না দেওয়া। আর পরামর্শের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আমানতদারিতা রক্ষা করা। এ পরামর্শের কারণে তার মনে কষ্ট পাওয়া কিংবা অন্য কোনো ক্ষতির দিকে দেখা ভিন্ন পরামর্শ না দেওয়া। কিংবা শুধু মনোরঞ্জনের জন্যই পরামর্শ দিয়ে দেওয়া—এসব থেকে বিরত থাকতে হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, আমি যা বলিনি তা যে ব্যক্তি আমার প্রতি আরোপ করবে সে যেন দোজখে তার স্থান করে নিল। কোনো ব্যক্তির কাছে তার কোনো মুসলমান ভাই পরামর্শ চাইল, কিন্তু সে তাকে ভ্রান্ত পরামর্শ দিল। সে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। আর যে ব্যক্তি দলিল-প্রমাণ ছাড়াই ফতোয়া দিল, তার এই ফতোয়াদানের পাপ তার ওপর বর্তাবে। (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ২৫৮)

দোষ গোপন রাখা

কেউ যদি আমার কাছে পরামর্শের জন্য আসে আর তার ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে অবগত করে, তাহলে সেই গোপন বিষয় আমার কাছে আমানত। তার এই গোপন রহস্য সবার কাছে বলে বেড়ানো জায়েজ নেই। এর দ্বারা ওই ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত আর অপমানিত করা হলো। তার সঙ্গে কখনো শত্রুতা তৈরি হলে তা বলে বেড়ানো অত্যন্ত গর্হিত কাজ। আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পরামর্শদাতা একজন আমানতদার। ’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫১২৮)

পরামর্শের ফায়দা

পরামর্শের মাধ্যমে কোনো কাজ করা হলে সবচেয়ে বড় ফায়দা হচ্ছে, প্রত্যেকের সুন্দর সুন্দর মতামত সামনে আসে। যখন প্রত্যেকের ভেতরের সুন্দর জিনিসগুলো সামনে আসে তখন এর মাধ্যমে সুন্দর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হয়। পাশাপাশি এর মাধ্যমে পরস্পর সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। যাদের সঙ্গে নিয়ে পরামর্শ করা হয় তাদের মনোরঞ্জনও হয়। 

আল্লাহ তাআলা আমাদের রাসুলের আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন

এই বিভাগের আরও খবর