img

নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে নিজেদের দলীয় কর্মী বা সমর্থক না ভাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি)। এই নির্দেশ দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘এমন কোনো আচরণ করবেন না, যাতে সরকারি বা গণকর্মচারী হিসেবে আপনাদের দলনিরপেক্ষতা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ’

গতকাল শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে দেশের ৬১ জেলার ডিসি ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে এক সভায় এমন পরামর্শ দেন সিইসি। সকাল ১০টা থেকে তিন ঘণ্টাব্যাপী ডিসি-এসপিদের সঙ্গে বৈঠক করেন সিইসি।

জেলা পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড কমিশন পর্যবেক্ষণে রাখবেন বলে জানান তিনি। সভায় চার নির্বাচন কমিশনার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সভায় ডিসি-এসপিদের নির্বাচনী রোডম্যাপসহ আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। ডিসি-এসপিদের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনের আগে প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ এবং ভোটকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিজিবির টহল দল বাড়িয়ে সদস্য সংখ্যা কমানো, ম্যাজিস্ট্রেটদের জ্বালানি খরচে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ এবং গুজব ঠেকাতে শক্তিশালী আইসিটি সেল গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। 

কমিশন থেকে রাজনৈতিকভাবে কোনো ধরনের হয়রানিমূলক মামলা না দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্বাচন সহায়ক পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে বলা হয়। 

লিখিত বক্তব্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের কোনো দলের পক্ষ হয়ে কাজ না করার পরামর্শ দিয়ে সিইসি বলেন, ‘জনগণের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের সহায়ক অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে হবে। নিরপেক্ষ থেকে আপনারা সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। ’

কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে আপনাদের কঠোরভাবে দায়িত্ব সচেতন হতে হবে। কোনো অবস্থায়ই নির্বাচন বিষয়ে আপনাদের কর্ম ও আচরণে এমন কিছুর প্রতিফলন হবে না, যাতে জনগণ ভাবতে পারেন যে আপনারা কোনো একটি দলের পক্ষে কাজ করছেন। ’

সংবিধান, আইন ও বিধি-বিধানের আলোকে দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দিয়ে ডিসি-এসপিদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, ‘প্রয়োজনে ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। যেকোনো মূল্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখবেন। জনগণের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের সহায়ক অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে হবে। নিরপেক্ষ থেকে আপনারা সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে প্রজাতন্ত্রের কর্মের কাঙ্ক্ষিত মান ও আদর্শকে সমুন্নত রাখবেন। ’ গণতন্ত্রের প্রয়োগ, চর্চা ও বিকাশে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখারও নির্দেশনা দেন তিনি। 

তিনি বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে উপেক্ষা করা যাবে না।    সংসদীয় পদ্ধতির বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নে মতপার্থক্য বা মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন নিয়ে সংশয় থাকলেও আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ ও সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা যেকোনো সংকট ও সংশয় নিরসনে সামর্থ্য রাখে। মতৈক্য ও সমঝোতা হবে, সংকট ও সংশয় কেটে যাবে। ’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে—এই আশা প্রকাশ করে  সিইসি বলেন, ‘ইভিএম প্রশ্নেও বিতর্ক রয়েছে। আমরা শুধু বিশ্বাস করি না, প্রমাণ পেয়েছি ইভিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্বাচনী সহিংসতা ও কারচুপি নিয়ন্ত্রণ সহজতর। প্রাপ্যতা সাপেক্ষে, অনূর্ধ্ব ১৫০টি আসনে ইভিএম প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। তবে প্রয়োজনে সব আসনে কিংবা ১৫০টির অধিক আসনে ব্যালটে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি ও সামর্থ্য আমাদের থাকবে। সে লক্ষ্যে নির্বাহী ও পুলিশ প্রশাসনকেও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সামর্থ্য ও প্রস্তুতি রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশে একই দিনে একই সময়ে ৪২ থেকে ৪৫ হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। কর্মযজ্ঞটি সহজসাধ্য না হলেও, অসাধ্য নয় এবং সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে সার্থকভাবেই সাধন করতে হবে। ’

সভায় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেন, ‘নির্বাচনকালীন আপনারা কমিশনের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হয়ে কাজ করবেন। কখনো দলীয় মনোভাব পোষণ করা যাবে না বা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না। অতি উৎসাহী হয়ে এমন আচরণ করবেন না, যাতে আপনাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ’

সভা শেষে ইসির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে সভায় আলোচনার বিষয়গুলো জানিয়ে বলা হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো এক বছর দুই মাসের বেশি সময় বাকি রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠেয় সব নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে তাদের ভূমিকা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কাউকে যেন হয়রানি করা না হয়, সে বিষয়টিও বলা হয়েছে। এ সময় মিডিয়া সেন্টারে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা ও মো. আলমগীর। 

ডিসি-এসপিদের প্রস্তাব

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র না বাড়িয়ে ভোট কক্ষ বাড়ানোর প্রস্তাব দেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররা। মূলত কেন্দ্রে পর্যাপ্তসংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনা করে তাঁরা এ প্রস্তাব দেন। নির্বাচন কমিশন এই প্রস্তাব বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। 

সভা শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আক্তার হোসেন বলেন, ‘জেলা পরিষদ ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতে যে নির্বাচনগুলো হবে, তা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের বিষয়ে আলাপ হয়েছে। ডিসি-এসপি সাহেবরা পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমরা মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে বলেছি। সব মানুষের জন্য যেন মৌলিক অধিকার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তা নিশ্চিত করতে বলেছি। ’

তিনি বলেন, ‘একটি ইউনিয়নে ৯-১০টি বা তার থেকেও বেশি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের যে সংখ্যা, তাতে পর্যাপ্তসংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা যায় না। এ জন্য আমরা ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমিয়ে  ভোট কক্ষ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলেছি। এখন যেহেতু যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, কাজেই ভোটকেন্দ্র কমালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা সহজ হবে। ’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠ প্রশাসনে রদবদল হয় না। এটি রুটিন ওয়ার্ক। কিছুদিন আগে পদোন্নতির কারণে আমরা ৪০টি জেলায় নতুন এসপি নিয়োগ দিয়েছি। ওই এসপিদের আমরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে বলেছি। ’

সভায় উপস্থিত অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল আইজি-ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মো. আতিকুল ইসলাম  কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা  ভোটকেন্দ্রের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। আমাদের প্রস্তাব ছিল ভালো স্কুল বা প্রতিষ্ঠানে, যেখানে অবকাঠামো ও যোগাযোগ ভালো, সেখানে একই এলাকার কয়েকটি কেন্দ্র করা যেতে পারে।    যেমন—একটি ইউনিয়নে বা ওয়ার্ডে আটটি কেন্দ্র আট স্থানে, সেগুলো চার স্থানে হতে পারে। একই ভেন্যুতে কেন্দ্র ও বুথ বাড়তে পারে। এতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে। ’

নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের সময় বিজিবির ২৫ জন সদস্য এক গ্রুপে টহল দেন। এতে একই সময়ে তাঁরা বেশি কেন্দ্রে যেতে পারেন না। কিন্তু ২৫ জন সদস্য দুই গ্রুপে টহল দিলে বেশি কেন্দ্রে নিরাপত্তা দিতে পারবে। এ জন্য বিজিবির টহল গ্রুপ বাড়িয়ে সদস্য সংখ্যা কমানোর পরামর্শ দিয়েছি। ’    

রংপুর ও খুলনা বিভাগের একাধিক ডিসি কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনের সময়ে ইসি প্রথমে যে সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়, পরে অনেক সময় তার চেয়ে বেশি নিয়োগ দিতে হয়। পরে অতিরিক্ত নিয়োগ পাওয়া ম্যাজিস্ট্রেটদের ইসি থেকে জ্বালানি খরচ দেওয়া হয় না। এ জন্য জ্বালানি খরচের বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।    

ঢাকা বিভাগের একজন ডিসি কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পক্ষ বা বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের গুজব বা অপপ্রচার ছড়ানো হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করে। এসব বিষয় তদারকির জন্য শক্তিশালী আইসিটি সেল গঠনের কথা বলা হয়েছে। 

দিনাজপুরের এসপি শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘উন্মুক্ত আলোচনায় আমাদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রের পরিবেশ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। অনেক কেন্দ্র আছে ভাঙাচোরা ভবন, যাতায়াতব্যবস্থা খারাপ, নির্বাচনের আগে ব্যালটসহ মালপত্র রাখতে সমস্যা; সেখানে থাকা-খাওয়ারও ব্যবস্থা নেই। এসব স্থানে নিরাপত্তা দেওয়াও কঠিন। এ কারণে ভালো স্থাপনায় কেন্দ্র করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন এসপি বলেন, ‘ভালো স্কুল-কলেজ বা ভবনে বেশি কেন্দ্র দিয়ে সেখানে নিরাপত্তা নজরদারি বাড়ানো সম্ভব। এটিই আমাদের দিক থেকে বলা হয়েছে। বাস্তব উদাহরণ দিয়ে সমস্যার কথা বলা হয়েছে। সিইসি এই প্রস্থাবে ইতিবাচক মত দিয়েছেন। ’

ফরিদপুরের এসপি মো. শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা তৈরি আছি, সেটা আমাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ’

এই বিভাগের আরও খবর