img

রাশিয়া যদি যুদ্ধ বন্ধ করে তাহলে যুদ্ধ থামবে। আর ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করলে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কালের কণ্ঠকে এ কথা বলেছেন কিয়েভ সিটির সাবেক কাউন্সেলর ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনকারী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইউক্রেনিয়ান ভিক্টোরির সহপ্রতিষ্ঠাতা ওলেনা হালুশ্কা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান  রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার চূড়ান্ত ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেছেন।এই ডিক্রির বৈশ্বিক মূল্য আসলে কতটুকু এবং এর প্রভাবই বা কী?

 

kalerkanthoওলেনা হালুশ্কা : পুতিনের ওই ডিক্রির কোনো আইনি ভিত্তি নেই। ওই ডিক্রি অবৈধ। ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান জেনোসাইড ও যুদ্ধ বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। এই যুদ্ধে স্পষ্টতই একটি সাম্রাজ্যবাদী ধরন আছে। এর লক্ষ্য ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড জয় করা ও জাতি হিসেবে ইউক্রেনীয়দের ধ্বংস করা। যদি এই নির্লজ্জ আগ্রাসন বন্ধ এবং দায়ীদের শাস্তি দেওয়া না হয়, তাহলে এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে। সেখানে কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর সীমানা পরিবর্তন হওয়া নতুন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠবে। স্পষ্টতই এটি সারা বিশ্বে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। 

কালের কণ্ঠ : রাশিয়া তো এর আগে ক্রিমিয়াও দখল করেছিল। তার মাধ্যমে ইউক্রেন, ইউরোপ এবং পশ্চিমা দেশগুলো কী বার্তা পেয়েছিল?

ওলেনা হালুশ্কা : ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করার মাধ্যমে রাশিয়া প্রথমবারের মতো ইউক্রেনের ভূমি দখল করে। ওই ঘটনার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ছিল দুর্বল। রাশিয়ার সঙ্গে বৈশ্বিক সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমানো যায়নি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরো জোরালো হয়েছে। যেমন, কলঙ্কিত রুশ-জার্মান পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম-২। চেচেন যুদ্ধ, জর্জিয়ায় আগ্রাসন—দুটির কোনোটির জন্যই রাশিয়াকে কখনো জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রথম অভিযান ও দখলদারি, সিরিয়ায় জেনোসাইড এবং এসব কিছুতে দায়মুক্তি আজ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পথ দেখিয়েছে। আমাদের সার্বভৌম অঞ্চলগুলোকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে ইউক্রেনের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং এই মুহূর্তে রুশরা অধিকৃত ভূখণ্ডগুলোতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘কামানের খোরাক’ হিসেবে তাদের জনশক্তিকে সমবেত করছে। এটি আরেকটি গুরুতর যুদ্ধাপরাধ। 

কালের কণ্ঠ : ভূখণ্ডগুলো ফিরে পেতে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে কিভাবে সাহায্য করছে?

ওলেনা হালুশ্কা : আমরা এরই মধ্যে অনেক আন্তর্জাতিক অংশীদারের কাছ থেকে সহায়তা পাচ্ছি। এ জন্য আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে ইউক্রেনের সব ধরনের সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের সম্মুখ সারির জন্য অত্যাধুনিক ন্যাটো ট্যাংক এবং জেট বিমান; সেই সঙ্গে কামান, প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র, সাঁজোয়া যান এবং ড্রোন ইত্যাদি প্রয়োজন। রুশরা প্রতিদিন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিক ও বেসামরিক অবকাঠামোর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এগুলো ঠেকাতে আমাদের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সহায়তা পাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। 

কালের কণ্ঠ : দৃশ্যত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কাছে রাশিয়া নতি স্বীকার করছে না। ওই নিষেধাজ্ঞায় ভুগছে অন্যান্য দেশ, বলতে গেলে গোটা বিশ্ব। পশ্চিমা দেশগুলো কিভাবে রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে পারে?

ওলেনা হালুশ্কা : রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়ছে না—এটি কিন্তু রাশিয়ার প্রচারণার একটি অংশ। অবশ্যই তাদের ওপর প্রভাব পড়ছে। রুশরা এই বড় যুদ্ধ শুরু করার পর সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে বাইরে থেকে নিষেধাজ্ঞার প্রভাবের প্রকৃত মাত্রা মূল্যায়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। উপরন্তু রুশরা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে পশ্চিমাদের নিয়মিত ‘ব্ল্যাকমেইল’ করছে। এটি অবশ্য তাদের দক্ষতার আরেকটি প্রমাণ। 

এখন ইউক্রেনের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত কোনো আলোচনা হতে পারে না। যেকোনো অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি কেবল রুশদের আবার শক্তিশালী হওয়ার জন্য সময় দেবে এবং তারা পরবর্তী সময়ে আরো কঠিন আঘাত করবে। রাশিয়ার লক্ষ্য যে শান্তি নয় তার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হলো ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মিনস্ক চুক্তির অভিজ্ঞতা। বর্তমান অবস্থায় রাশিয়া লড়াই বন্ধ করলে যুদ্ধ হবে না, ইউক্রেন লড়াই বন্ধ করলে ইউক্রেন বলে আর কিছু থাকবে না। 

কালের কণ্ঠ : রাশিয়া বলে আসছে ইউক্রেন নিয়ে তার উদ্বেগ পশ্চিমা দেশগুলো নিরসন করেনি এবং এ ক্ষেত্রে কূটনীতি ব্যর্থ হয়েছে। তাই রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করতে বাধ্য হয়েছে। রাশিয়ার ওই দাবি কতটা যৌক্তিক?

ওলেনা হালুশ্কা : অবশ্যই না। এটি রাশিয়ার অবৈধ আগ্রাসনকে ন্যায্যতা দেওয়ার অপ্রচেষ্টা। এই যুদ্ধ কখনো ন্যাটো নিয়ে ছিল না। যদিও রাশিয়া শুরুতে এটি বলার চেষ্টা করেছিল। ইউক্রেন ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে ‘বুদাপেস্ট স্মারক সুরক্ষা নিশ্চয়তার’ বিনিময়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রাগার ছেড়ে দেয়। কিন্তু সেই নিশ্চয়তা ২০১৪ বা ২০২২ সালে কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৪ সালে ইউক্রেন যখন প্রথম আক্রান্ত হলো আমরা তখন নিরপেক্ষ দেশ ছিলাম। ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তখন ইউক্রেনে জনসমর্থন ৩০ শতাংশও ছিল না। তাই রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণ কখনো তার নিরাপত্তা উদ্বেগ ছিল না, বরং সব সময় তাদের সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য ছিল। 

কালের কণ্ঠ : ঢাকায় রুশ দূতাবাস কর্মকর্তারা বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ যে ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, ইউক্রেনের কিছু অঞ্চলের জনগণও সেই অবস্থায় পড়েছিল। তাদের মুক্ত করতে রাশিয়া অভিযান চালিয়েছে। 

ওলেনা হালুশ্কা : রুশ প্রপাগান্ডায় বলা হয়ে থাকে, ওই অঞ্চলগুলোর জনগণ রাশিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে চেয়েছিল। এটি পুরোপুরি মিথ্যা। বন্দুকের মুখে ও বল প্রয়োগ করে যে অবৈধ জরিপ করা হয়েছে তার দিকে আমি আপনাদের দৃষ্টি দিতে বলব। রুশরা একে ‘গণভোট’ বলছে। ওই জরিপের সময় অনেক মানুষ পালিয়ে ইউক্রেন সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চলে আসছিল। গণতন্ত্র বা জনগণের ইচ্ছার কোনো সম্পর্ক ওই জরিপে ছিল না। 

কালের কণ্ঠ : আপনার দৃষ্টিতে রাশিয়া ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী?

ওলেনা হালুশ্কা : পুতিনের লক্ষ্য ইউক্রেন দখল করা। যদি ইউক্রেন প্রতিরোধ গড়ে তোলে তবে তাকে ধ্বংস করা। 

কালের কণ্ঠ : তাহলে এই যুদ্ধ কিভাবে থামানো যাবে?

ওলেনা হালুশ্কা : কেবল ইউক্রেনের পূর্ণ জয়ের মাধ্যমে। একই সঙ্গে এবারসহ অতীতের আগ্রাসনগুলোর জন্য রুশদের জবাবদিহির আওতায় আনার মাধ্যমে। 

কালের কণ্ঠ : ব্যস্ততার মাঝে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 

ওলেনা হালুশ্কা : ‘দিয়াকুইও’—ইউক্রেনীয় ভাষায় আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।

এই বিভাগের আরও খবর