img

অবিভক্ত ভারতবর্ষে তখনো ব্রিটিশ সূর্য অস্ত যায়নি, তেমন এক সময়ে ১৯৪১ সালের ১১ই অক্টোবর বাংলায় ১৫ মিনিটের সাপ্তাহিক সম্প্রচার শুরুর মাধ্যমে যাত্রা হয়েছিল বিবিসি বাংলার রেডিও কার্যক্রমের। পরে সংবাদ সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। 

কিন্তু ২৯শে সেপ্টেম্বর বিবিসি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, বাংলাসহ ১০টি ভাষার রেডিও সম্প্রচার বন্ধের প্রস্তাব গৃহিত হয়েছে, যদিও কোন ভাষা বিভাগই পুরোপুরি বন্ধ করা হচ্ছে না এবং অনেকগুলো এখন শুধু অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। 

বিবিসি কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের ফলে ৮১ বছর সম্প্রচারের পর বিবিসি বাংলার রেডিও অপারেশন বন্ধ হতে যাচ্ছে।

দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের মধ্যে রয়েছেন নানা বয়স, লিঙ্গ আর শ্রেণী পেশার মানুষ। আর বাংলাদেশে বিবিসির 'ফ্ল্যাগশিপ' প্ল্যাটফর্ম বলতে এখনো তারা রেডিও অনুষ্ঠানকে বুঝে থাকেন বলে বিবিসিকে বলেছেন অনেক শ্রোতা।

সেই রেডিও সম্প্রচার বন্ধের ঘোষণায় শ্রোতাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। 

'অত্যন্ত দুঃখিত': কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বিবিসিকে বলেছেন, ছাত্রাবস্থায় যখন তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন তখন থেকেই তিনি বিবিসি বাংলার শ্রোতা ছিলেন। 

এরপর মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রেও তিনি বিবিসি প্রচারিত সংবাদের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। 

তিনি বলছেন, তার দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ারে তিনি সব সময় বিবিসিকে একটি 'গ্রহণযোগ্য' এবং 'বিশ্বাসভাজন' সংবাদ মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন। এ কারণেই রেডিও পরিষেবা বন্ধের ঘোষণায় তিনি 'শকড' বা হতবাক হয়েছেন। 

তিনি বলেন, "ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে একটি বিশ্বস্ত সংবাদ মাধ্যম হিসেবে বিবিসির বিরাট গ্রহণযোগ্যতা এখনো আছে।" 

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক

তিনি বলেন, "বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামে পরবর্তীতে নয় মাস ব্যাপী দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধে বিবিসি অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। সঠিক সংবাদগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরেছে, জনমত সৃষ্টিতেও অনেক সংবাদ তারা পরিবেশন করেছে।" 

"সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলে বিবিসির গ্রহণযোগ্যতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা, এটা এখানে যারা সংবাদ মিডিয়ায় কাজ করেন তাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। এটি বন্ধ হয়ে যাবে এতে ব্যক্তিগতভাবে আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমি শকড," বলেন তিনি। 

এর আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকার জন্য বিবিসি বাংলা সার্ভিসকে 'ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ' নামে বিশেষ সম্মাননা দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। 

বিবিসি এবং ব্রিটিশ সরকারকে উদেশ্য করে কৃষিমন্ত্রী এবং সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, "ব্যয়বহুল ইউক্রেন যুদ্ধের বাজেট কমিয়ে বিবিসির সংবাদ প্রচারে বিনিয়োগ করা উচিৎ।"

'অগ্রহণযোগ্য' বলছেন বিএনপি মহাসচিব

বাংলাদেশের আরেক প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নেতৃবৃন্দও প্রায় একই ধরণের মন্তব্য করেছেন বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার বন্ধের ঘোষণায়। 

দলটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, বিবিসি তার দল নিরপেক্ষ অবস্থান এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সম্প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে মানুষকে স্বচ্ছ ধারণা পেতে সাহায্য করেছে। 

বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরবিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, বিবিসির রেডিও সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি ক্ষতি। 

তিনি বলছেন, "এই বন্ধ হয়ে যাওয়াকে আমি বলতে পারি শুধু আমার দলের কাছে না, বাংলা ভাষাভাষী প্রত্যেকটি মানুষের কাছে একটা অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার। তার ওপর আমরা যখন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছি, সেই সময় বিবিসির বাংলার রেডিও অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।" 

তিনি নিজেকে বিবিসির রেডিও সংবাদের দীর্ঘদিনের শ্রোতা বলে উল্লেখ করেন। 

বিবিসি বাংলার রেডিও যে কারণে জনপ্রিয়

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশে সংবাদ প্রকাশের সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং পক্ষপাতহীন সংবাদ প্রচারের জন্যই এ সংস্থাটির ওপর মানুষের আস্থা স্থাপিত হয়েছে। 

বিভিন্ন সময় কর্তৃপক্ষের নানা বিধিনিষেধের কারণে অনেক সময় সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে কোন ঘটনার সকল পক্ষের বক্তব্য সম্বলিত সংবাদ পাওয়া পাঠক বা শ্রোতার জন্য কঠিন ছিল। 

সেসময় তাদের কাছে প্রভাবমুক্ত ও পক্ষপাতহীন সংবাদের একমাত্র উৎস ছিল বিবিসি। 

বিবিসিলেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী বলেন, "যেহেতু তখন মানুষের সংবাদ প্রাপ্যতা সীমিত ছিল, এবং যেহেতু বিভিন্ন সংবাদের মধ্য থেকে সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা কিছুটা কঠিন, তাই মানুষের আস্থা ছিল বিবিসির সংবাদের প্রতি।"

একই সাথে বিবিসিও তার সংবাদ পরিবেশনে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের বক্তব্য নিশ্চিত করেই সংবাদ পরিবেশন করে, যে কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতাদর্শগত বিভেদ থাকলেও, দল-মত-নির্বিশেষে সবার কাছে বিবিসির গ্রহণযোগ্যতার এটাই কারণ বলে মনে করেন মি. চৌধুরী। 

তিনি বলেন, "বিবিসির সরকার পরিবর্তনে কোন স্টেক ছিল না, এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দ্বিতীয়ত বিবিসি নিজেকে রাজনৈতিক মনে করত না, বিবিসি নিজেকে রাজনৈতিক দায়িত্বপ্রাপ্ত বলে মনে করত না, সেই কারণে এই জিনিসটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে।"

শ্রোতাদের হতাশা

বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার বন্ধের খবর প্রকাশিত হবার পর ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রায় সব সংবাদ মাধ্যম এ ঘোষণা নিয়ে সংবাদ প্রচার করেছে। গণমাধ্যমে কলাম লিখেছেন কেউ কেউ, সামাজিক মাধ্যমে অনেকে পোষ্ট করছেন এ নিয়ে নানা মতামত। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিবিসির এ সংক্রান্ত খবরটির নিচে মন্তব্য করেছেন কয়েক হাজার মানুষ, যার বেশিরভাগই আবেগময় এবং নস্টালজিক। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি

কেউ কেউ বলেছেন বিবিসি বাংলা তাদের সংবাদ বা খবর জানার আকাঙ্ক্ষাকে কিভাবে পূরণ করেছে এবং তার বস্তুনিষ্ঠতায় তারা কতটা ভরসা রাখতেন। 

কেবল ভার্চুয়াল প্রতিক্রিয়া নয়, শ্রোতাদের নানা ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর মন্তব্যেও। 

সানজিদা নামের একজন বলেন, "আমার হলে টিভির অপশন নেই, টিভি রুম আছে, কিন্তু সেখানে সংবাদ দেখায় না, তাই আমি বিবিসির সংবাদটা পছন্দ করতাম।"

রাবেয়া তুলি নামে একজন শিক্ষার্থী বলেন, "ফোনে ধরেন ডাটা নেই, কিন্তু বাটন ফোন ইউজ করেও আমি বিবিসি শুনতে পারি। ধরেন কারেন্ট নাই, কিন্তু আমরা বিবিসির সংবাদে খেলার আপডেটটা ঠিকই শুনে নিলাম।" 

চৈতী হালদার নামে একজন শিক্ষার্থী বলেছেন, "যেহেতু অনলাইনের যুগ প্রচুর নিউজ আসে ফিডে, কিন্তু বিবিসির সংবাদটা সবাই মনে করে সত্যতা আছে।" 

রুমানা বলেছেন, "চাকরির পরীক্ষা দেয়ার জন্য অনেক স্টুডেন্টস বিবিসি শোনে, বন্ধ হয়ে গেলে তাদের জন্য একটা ক্ষতি হবে। হলে সবাই খবরের কাগজ রাখতে পারে না। কিন্তু ৩০ মিনিটের অনুষ্ঠানে সে জাতীয় আন্তর্জাতিক খবরের পুরোটা জেনে যেতে পারে।" 

তিতলি সুলতানা নামে আরেকজন মনে করেন, "অন্য যে কোন মিডিয়ার তুলনায় বিবিসি নির্ভরযোগ্য। সে কারণে রেডিও অনুষ্ঠান মিস করবো আমি।"

এই বিভাগের আরও খবর