মিয়ানমার সীমান্তের ‘পরিস্থিতি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক’
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলমের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওই মন্তব্য করেন।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি ও সেখান থেকে গোলায় বাংলাদেশের ভেতরে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমারের কাছে প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ।গত মঙ্গলবার ঢাকায় কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন না। গতকাল তিনি আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেছেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে।
ওই সাক্ষাতের পর চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, ‘আমরা অনেক বিষয়ে আলোচনা করেছি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ’
মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, মিয়ানমার থেকে গোলা বাংলাদেশে এসে পড়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বিষয়টি তুলেছেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ’
মিয়ানমার নিয়ে পর্যবেক্ষণ জানতে চাইলে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমার কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। এ জন্য আমি দুঃখিত। ’
পরে এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব খুরশেদ আলম বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত পরিস্থিতি অন্যদের মতো চীনের রাষ্ট্রদূতকেও অবহিত করেছে বাংলাদেশ। চীন আগে থেকেই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার অংশ ছিল। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ চীনকে অনুরোধ জানিয়েছে।
গত মঙ্গলবার কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে না আসার বিষয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘অবশ্যই কারণ ছিল। আমরা কোনো বন্ধুপ্রতিম দেশের কাছে ওভাবে ব্যাখ্যা চাই না। তবে তাদের সমস্যা ছিল। ’
বিষয়টি নিয়ে বেইজিং নেপিডোর সঙ্গে আলোচনা করবে কি না জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘তারা (চীন) আমাদের আশ্বস্ত করেছে, যত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে ব্যাপারে তারা কথাবার্তা বলবে। ’
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব খুরশেদ আলম বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি—দুটি নিয়েই চীন মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলবে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি, দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু করতে। এখানে যে সামাজিক পরিস্থিতি ভালো না। ’
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য ঘরবাড়ি বানানো আছে। রোহিঙ্গারা সেখানে গেলে থাকতে পারবে। নিরাপত্তা, সুরক্ষা নিশ্চিত করবে মিয়ানমার।
মিয়ানমারে যুদ্ধ চলছে, এখন কি প্রত্যাবাসন সম্ভব?—এ প্রশ্নের জবাবে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘মিয়ানমারে যুদ্ধ হচ্ছে। যে জায়গায় নিয়ে যাবে (রোহিঙ্গাদের), সেখানে তো যুদ্ধ নেই। ’
প্রত্যাবাসনের জন্য চীন কোনো সময়সীমা দিয়েছে কি না জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, চীন কোনো সময় দেয়নি। আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি ঠিক করতে হবে। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘চীনের আশ্বাসে আমরা বিশ্বাস করি না করি তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু চীন যেহেতু একটি বন্ধুপ্রতিম দেশ, আমরা মনে করি, তার কাছে বললে চীন যথাস্থানে তা পৌঁছে দেবে। যতটা সম্ভব চাপ দেওয়ার ক্ষমতা চীনের আছে। ’
ইন্দোনেশিয়ার আদালতে শুনানি
এদিকে ইন্দোনেশিয়ার সাংবিধানিক আদালতে গতকাল সোমবার বিকেলে মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদনের শুনানি হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক চলতি মাসের শুরুর দিকে মিয়ানমারের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জেনোসাইড, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জান্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন।
আবেদনকারীদের অন্যতম ইন্দোনেশিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্য মারজুকি দারুসমান গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, আদালতে তাঁদের আবেদনটি উঠেছিল। শুনানিও হয়েছে। সেখানে আদালত তাঁদের আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে আবেদন করতে বলেছেন। এরপর শুনানির জন্য আদালত আবারও তারিখ নির্ধারণ করতে পারেন। মারজুকি দারুসমান বলেন, ইন্দোনেশিয়ার সংবিধানের সঙ্গে সংগতি রেখে মামলার আবেদনে শব্দগত কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। এটি জটিল কিছু নয়।
মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান সংঘাত, আতঙ্ক ও ক্ষুধা : জাতিসংঘ
জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে গতকাল মিয়ানমারের অবনতিশীল পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাদা আল-নাশিফ। তিনি বলেন, মিয়ানমারের জনগণ দ্রুত অবনতিশীল সংঘাত পরিস্থিতিতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এখন তাদের বসবাস করতে হচ্ছে ক্রমবর্ধমান দুর্ভোগ, আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা আর ক্ষুধার সঙ্গে। এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ এবং পুনরুদ্ধারের জন্য শান্তি, গণতন্ত্র ও টেকসই উন্নয়নে জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল।
ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার তাঁর বক্তব্যে রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত এবং মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গোলা নিক্ষেপের কথাও মানবাধিকার পরিষদকে জানান।
ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাদা আল-নাশিফ বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্রমবর্ধমানভাবে ও নির্বিচারে আক্রমণ ও অস্ত্র ব্যবহার করছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মিয়ানমারে সংঘাতে কমপক্ষে দুই হাজার ৩১৬ জন নিহত হয়েছে।
হোয়াইক্যং সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে আমাদের টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, গতকাল সোমবার ভোর থেকে সীমান্তে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপ শুরু হয়েছে। হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া ও হারাংঘাঘোনা সীমান্ত এলাকার লোকজন সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির বিকট আওয়াজ পায়। তবে উত্তরের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু, উখিয়ার রহমতের বিল ও আনজুমানপাড়া সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি গত তিন দিন।